ইমরান খান: রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে কক্সবাজার কারাগারের কয়েদি জাহাঙ্গীরের মৃত্যু ঘটে গত বছর ২২ ডিসেম্বর। শরীরে গরম পানি পড়ে দগ্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানায়। তাদের ভাষ্য, ১৬ ডিসেম্বর চুলা থেকে গরম পানির পাতিল নামানোর সময় পানি পড়ে সারা শরীর ঝলসে যায়। পরে তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।
সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তবে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে তদন্তের দাবি জানিয়ে তার মা ছলেমা খাতুন করে বলেন, ঘটনার দুদিন পরে ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজার কারাগারের জেলার মোস্তফা কামাল ফোনে ছেলের দুর্ঘটনার সংবাদ জানিয়ে ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু হঠাৎ করে হাসপাতালে দায়িত্বরত একজন কারারক্ষী ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জোর করে আমাকে বাড়ির উদ্দেশে গাড়িতে উঠিয়ে দেন।
গত ২২ ডিসেম্বর সকালে বাড়ি পৌঁছানোর পর দুপুর ১২টায় ফোন করে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়।
শুধু জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রে নয়, বরং সারা দেশে ঘটে যাওয়া কয়েকটি কয়েদির মৃত্যুর ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যের সঙ্গে সন্দেহ ও উদ্বেগ জানিয়েছে নিহতের পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৬৫ কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জন দন্ড প্রাপ্ত ও ৩৭ জন বিচারাধীন মামলার আসামি ছিলেন।
এছাড়া চলতি বছর ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৯ কারাবন্দির মৃত্যু ঘটেছে। আর ২০১৮ সাল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৩৫৩ কারাবন্দির। এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে বন্দিদের মৃত্যু বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান গণগ্রেপ্তার চালানো হয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের সময় নির্যাতনের কারণেও মৃত্যুর সংখা বেড়েছে বলে আমরা শুনেছি।
তবে কারণ যেটাই হোক না কেন, কারাবন্দির ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যানুসারে সারা দেশের কারাগারগুলোয় উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে বন্দিদের মৃত্যুর সংখ্যা। এসব মৃত্যুকে কারা কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক মৃত্যু বললেও মানবাধিকার কর্মীরা বলছে, গ্রেপ্তারের আগে বা পরে নির্যাতনের কারণেও অনেকের মৃত্যু হয়েছে। দেশের কারাগারগুলোয় বন্দিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন কারাগারে অন্তত ৬ কয়েদির মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে গত ৬ জানুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় কেরানীগঞ্জ কারাগারের বন্দি বাচ্চু হাওলাদার ও গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের কয়েদি জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্য আবুল হোসেন খোকনের মৃত্যু ঘটে। কারাগার দুটির কর্তৃপক্ষ বলছে, কারাগারে অসুস্থ হলে তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
গত ১১ জানুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাশিমপুর কারাগারের মানিক মিয়া (৭০) নামে মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত এক বন্দির মৃত্যু হয়। এ বিষয়ে কাশিমপুর কারাগারের সহপ্রধান কারারক্ষী ইসমাইল জানান, তিনি একটি মামলায় মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত বন্দি ছিলেন। কারাগারে অসুস্থ হলে তাকে শহীদ তাজউদ্দীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর তার মৃত্যু হয়।
গত ১২ জানুয়ারি বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মোক্তার হোসেন নামে এক কারাবন্দির মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে বগুড়া জেলা কারাগারের জেল সুপার মনির আহমেদ জানান, গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর মাদকাসক্ত মোক্তার হোসেনকে কারাগারে পাঠান আদালত। কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ৭ জানুয়ারি তাকে শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টায় তিনি মারা যান।
এছাড়া গত শুক্রবার গাড়ির নিচে চাপা পড়া নারীকে প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তা টেনেহিঁচড়ে নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক কারাবন্দি মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহের মৃত্যু হয়। শুক্রবার ঢাকার কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে তাকে ঢামেক হাপসাতালে নিয়ে গেলে বিকালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
একইদিন রাতে চাঁদপুর জেলা কারাগারের জামিন প্রাপ্ত আসামি মোস্তফা মিস্ত্রির (৪০) মৃত্যু ঘটে। জেলা কারাগারে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শনিবার দুপুরে তার লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের নিকট হস্তান্তর করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) কাজী আরফান আশিক বলেন, কয়েদিদের মৃত্যুর বিষয়ে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ আসেনি। কমিশনের প্রতিনিধি দল নিয়মিত কারাগারগুলো পরিদর্শন করে। এ সময় কোনো অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনা চোখে পড়লে আমরা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি। তবে কারাগারগুলোয় চিকিৎসক ও নার্সদের সংকট রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তরের সহকারি কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মাইন উদ্দিন ভ‚ঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সহকারী কারা পরিদর্শক (প্রশিক্ষণ ও ক্রীড়া) নাহিদা পারভীনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। কয়েকদিন চেষ্টা করেও এ বিষয়ে নাহিদা পারভীনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগ করা হলে ‘আগামীকাল ফোন করুন’ বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। পরে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে আর পাওয়া যায়নি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য