-->
শিরোনাম
কম্পানি আইনের আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য : হাইকোর্ট

কম্পানি আইন যুগোপযোগী করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে হাইকোর্টের ১৪ পরামর্শ

নিজস্ব প্রতিবেদক
কম্পানি আইন যুগোপযোগী করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে হাইকোর্টের ১৪ পরামর্শ

দেশে বিদ্যমান কম্পানি আইন সংশ্ধোন করে ভারতের আদলে নতুন কম্পানি আইন প্রণয়ন করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। মামলার সংখ্যানুপাতে প্রত্যেক জেলায় এক বা একাধিক কম্পানি ট্রাইব্যুনাল ও প্রত্যেক বিভাগে একটি করে কম্পানি আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠাসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ১৪টি পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এসব পরামর্শের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাণিজ্যমন্ত্রী, বাণিজ্যসচিব ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যানকে রায়ের অনুলিপি পাঠাতে বলা হয়েছে। আদালত বলেছেন, দেশকে উন্নত পর্যায়ে নিতে হলে বিদ্যমান কম্পানি আইনের আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য।

 

বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রায়ে এ পরামর্শ দিয়েছেন। ‘মো. উজ্জল বনাম টপটেন ফেব্রিক্স এন্ড টেইলার্স লিমিটেড ও অন্যান্য’ নামে টপ টেন ফেবিক্স অ্যান্ড টেইলার্স লিমিটেডের মালিকানা নিয়ে করা মামলা নিষ্পত্তি করে এই রায় দিয়েছেন। মালিকানা নিয়ে দ্বন্ধের জেরে হাইকোর্টের কম্পানি বেঞ্চে ২০১৯ এবং ২০২১ সালে দুটি আবেদন করেন টপটেন ফেবিক্স অ্যান্ড টেইলার্স লিমিটেডের তিন ভাইয়ের এক ভাই। আবেদনকারীর নাম মো. উজ্জল। বিবাদী অপর দু’ভাই মো.সৈয়দ হোসেন ও আব্দুল আউয়াল।

 

১৯৯০ সালে এলিফেন্ট রোডে টপটেন নামে একক মালিকানায় মো. সৈয়দ হোসেন কাপড় এবং সেলাইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০১১ সালে আপন ছোট ভাই মো. উজ্জলকে ৩৫ শতাংশ এবং মো. আব্দুল আউয়ালকে পাঁচ শতাংশ শেয়ার দেন। বাকী ৬০ শতাংশ নিজে রাখেন। তবে কম্পানি পরিচালনায় মতের অমিল হওয়ায় উজ্জল হাইকোর্টে দুটি আবেদন করেন।

 

রায়ে হাইকোর্ট বলেন, আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে হুদা ভাসি চাটার্ড ফার্ম দিয়ে আবেদনকারীর শেয়ারের মূল্য যাচাই ও নির্ধারণ করতে হবে। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে আবেদনকারীর শেয়ার বড় ভাই সৈয়দ হোসেনকে কিনে নিতে নির্দেশ দেন।

 

মামলার রায়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এসব পরামর্শ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। মামলাটি নিষ্পত্তি করে গত বছর ২৫ আগস্ট রায়টি দিয়েছিলেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ। ২৩২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি গত ২০ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আদালতে আবেদনকারীপক্ষে আইনজীবী ছিলেন মারগুব কবির ও আব্বাস উদ্দিন। বিবাদী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক, মেহেদী হাসান চৌধুরী ও মুহাম্মদ হারুনুর রশীদ।

 

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, বর্তমান কম্পানি আইন, ১৯৯৪ অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগের অনুপযোগী। কম্পানি আইন ১৯৯৪ এটিকে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি পুরোটাই কম্পানি আইন ১৯১৩-ই রয়ে গেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিতে হলে অবশ্যই ১০৯ বছরের পুরোনো কম্পানি আইন আমূল পরিবর্তন একান্তভাবে অপরিহার্য। আদালত আরও বলেন, প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে কয়েক লাখ প্রাইভেট ও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির জন্য একটি মাত্র কোম্পানি আদালত। অসংখ্য কোম্পানি বিরোধের জন্য একটি কোম্পানি বেঞ্চ থাকার কারণে কোম্পানির দৈনন্দিন কার্যক্রম চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারলে কোম্পানিগুলো নিজে উন্নত হয়ে দেশকেও উন্নত করতে ভূমিকা রাখতে পারবে। আধুনিক ও উন্নত বিশ্বের আদলে আমাদের কোম্পানি আইনকে ঢেলে না সাজালে উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ১৪টি পরামর্শ :

এক. ভারতের কম্পানি আইনের আদলে আইনটি সংশোধন করে নতুন আইন প্রণয়ন ও আইনটির হালনাগাদ করতে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।

 

দুই. মামলার সংখ্যানুপাতে প্রত্যেক জেলায় এক বা একাধিক কম্পানি আইনের ট্রাইব্যুনাল গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।

 

তিন. প্রত্যেক বিভাগে একটি করে কম্পানি আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।

 

চার. কম্পানি আইনের অধীনে অপরাধের জন্য বিশেষ ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।

 

পাঁচ. যৌথ মূলধনী কম্পানি ও কার্যসমূহের পরিদপ্তরকে (আরজেএসসি) আধুনিকীকরণ ও পরিদপ্তরটির আইনি কাঠামো শক্তিশালী করতে পদক্ষেপ নেওয়া।

 

ছয়. ‘কর্পোরেট ল কোড’ বাংলায় প্রকাশ করে তা প্রত্যেক কম্পানির কার্যালয়ে রাখার ব্যবস্থা করা।

 

সাত. পদ সৃষ্টি করে প্রত্যেক কম্পানিতে একজন স্থায়ী আইন কর্মকর্তা ও অভিজ্ঞ আইনজীবীকে পরামর্শক রাখা বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ নেওয়া।

 

আট. প্রত্যেক জেলায় ‘কম্পানি গঠন, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা’ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন। বছরে অন্তত একবার প্রত্যেক কম্পানির কর্মকর্তার জন্য সে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার ব্যবস্থা করা।

 

নয়. প্রত্যেক কম্পানিতে একজন নিরপেক্ষ পরিচালক, সচিব, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার ব্যবস্থা করা।

 

দশ. পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকার বেশি হলে কম্পানিতে সার্বক্ষণিক সচিব রাখা বাধ্যতামূলক করতে পরিপত্র জারি করা।

 

এগারো. কম্পানির নিবন্ধনে যে শহরের কথা উল্লেখ থাকবে সে শহরে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বাধ্যতামূলক করতে পরিপত্র জারি করা।

 

বারো. শেয়ারবাজারসংক্রান্ত আইনের সঙ্গে সংঘাত, এজিএমে অনাহূত পরিস্থিতি এড়ানো ও আয়কর দাখিল সহজ করতে পদক্ষেপ নেওয়া। তেরো. এজিএমে বা অন্য কোনো উপলক্ষে অংশীদারদের উপহার, উপঢৌকন, নগদ অর্থ দেওয়া নিষিদ্ধ করে এবং এজিএম করতে না পারলে কম্পানির নিবন্ধন বাতিলের বিধান রেখে বিধি প্রণয়ন করা। চৌদ্দ. আরজেএসসিতে লাভ-ক্ষতি-উদ্বৃত্তের হিসাব, আয়কর বা কর দাখিলের বিধি-বিধান করা।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version