মুহাম্মদ গালীব খান। রাতারাতি নিজের ভাগ্য বদলিয়েছেন তিনি। আঙুল ফুলে হয়েছেন কলাগাছ। তিনি সরকারি চাকরিজীবী। সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক। ঘুষ-দুর্নীতি করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। অভিযোগ গড়িয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। তদন্ত হচ্ছে। সম্প্রতি এ তদন্ত আরো বেগ পেয়েছে তার নিত্যনতুন দুর্নীতির তথ্যে। অভিযোগ ছিল মাত্র ৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদের। কিন্তু তদন্তে নেমে বিস্মিত হচ্ছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তি রয়েছে গালীব-রাখি দম্পতির। সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক হওয়ার সুবাধে বিভিন্ন সমিতির নিবন্ধন, নির্বাচন ও নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন তিনি। এছাড়া নানা অবৈধপন্থায় বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি ও তার স্ত্রী তানিয়া সুলতানা রাখি। তার স্ত্রী রাখি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে ট্রেড অপারেশন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
প্রায় ৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর মুহাম্মদ গালিক খান ও রাখির বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করে দুদক। অভিযোগে তুলনায় বাস্তবে তার অবৈধ সম্পদ অনেক অনেক বেশি বলেই তথ্য পেয়েছে দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন। ওই মামলায় সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মুহাম্মাদ গালীব খানের বিরুদ্ধে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে ২ কোটি ১৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ রয়েছে। সেইসঙ্গে তার স্ত্রী ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে ট্রেড অপারেশন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট তানিয়া সুলতানা রাখির বিরুদ্ধে ২ কোটি ৮৩ লাখ ২৫ হাজার ৫২০ টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থে স্ত্রী তানিয়া সুলতানা রাখির নামে গড়েছেন ইটভাটা, এজিএস ফার্মা অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস নামে ওষুধ কোম্পানি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। রাখির নামে ফরিদপুরে রয়েছে ২৫৪ শতাংশ জমি। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ৩.৫০ কাঠা জমি, বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে সাড়ে ৩ কাঠার প্লট, ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডে এবং খিলগাঁও এলাকায় দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং শেয়ারবাজারে রয়েছে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডে তানিয়া সুলতানার নামে কেনা ফ্ল্যাটটির মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৬৪ লাখ টাকা।
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফ্ল্যাটের ইন্টেরিয়রই করা হয়েছে ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে। ফ্ল্যাট ক্রয়ের চুক্তিপত্র অনুসারে, এটির মূল্য ১ কোটি সাড়ে ৯ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৭ কোটি ২৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪২ লাখ ৬৮ হাজার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া গেলেও ২ কোটি ৮৩ লাখ ২৫ হাজার ৫২০ টাকার সম্পদের সপক্ষে কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। দুদক অনুসন্ধান শুরুর পর নিজের ও স্ত্রী তানিয়া সুলতানার নামে যেসব বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে সেগুলো থেকে টাকা তুলে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে সেগুলো সরিয়ে নেয়া হয়। এরকম প্রায় ১০-১১টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তার প্রায় ১০ থেকে ১১ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ গোপন করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। দুদক গালীব ও তার স্ত্রীর বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে দিলে তারা নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ওই সব ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এখনো লেনদেন অব্যাহত রেখেছেন।
গালীব খান বর্তমানে বাংলাদেশ সমবায় একাডেমি কুমিল্লার অধ্যাপক (প্রশাসন) হিসেবে কর্মরত। উপনিবন্ধক পদমর্যাদায় বর্তমান কর্মস্থল এটি। সূত্রে জানা গেছে, ২৭ বিসিএসের কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয়ে যোগদান করেন গালীব । টানা ৮ বছর একই দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘদিন একই পদে থাকার কারণে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার লাইন-ঘাট ছিল তার নখদর্পণে। তবে সবচেয়ে বেশি অর্থ তিনি আয় করেন বিভিন্ন কো-অপারেটিভ সোসাইটির বিতর্কিত নির্বাচন ও অবৈধ কমিটি অনুমোদন, অডিট রিপোর্টে উল্লেখিত বিভিন্ন তথ্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে, ফাইল আটকে রেখে জিম্মি করে অর্থ আদায় করেন তিনি।
মালিটলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি ডেসটিনিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে অর্থ আত্মসাতে সহযোগিতা করেছেন গালীব । ডেসটিনির অভৈধ কমিটিকে বৈধতা দিয়ে তাদের কাছ থেকে অন্তত ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল, করোনায় যখন কঠোর লকডাউন চলছিল তখন ডেসটিনি মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির অ্যাডহক কমিটির একটি ‘সভা’ দেখান তিনি। কথিত ওই সভায় সিদ্ধান্ত দেখানো হয় যে, নোটিশ জারির ১৫ দিনের মধ্যে যারা ৫০০ টাকা জমা দিতে পারবেন, তাদের সদস্যপদ হালনাগাদ করা হবে। পরে তাদের আর সময় বাড়ানো হবে না। যারা লকডাউনের কারণে সঞ্চয়ী আমানত জমা দিতে পারবেন না, তাদের বিষয়ে পর্ষদ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ডেসটিনি কো-অপারেটিভের অ্যাডহক কমিটির এমন কল্পিত সভায় সমিতির ৮ লাখ সদস্যের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত দেখানো হয়। পরে কথিত ‘নবনির্বিাচিত কমিটি’র কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে ডেসটিনির অ্যাডহক কমিটি। এভাবে ‘নির্বাচন’ এবং ‘নির্বাচিত কমিটি’ দেখানো, ডেসটিনির বিতর্কিত কমিটিকে বৈধতা দানের নেপথ্যে ছিলেন সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মুহাম্মদ গালীব খান।
নিম্নআয়ের সহস্রাধিক মানুষের সংগঠন রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আগারগাঁওয়ে ‘মমতা বহুমুখী সমবায় সমিতি’। নতুন করে সমিতির সদস্য অন্তর্ভুক্তি, নতুন কমিটি গঠন, সরকারি সম্পত্তি দখল করে খালের ওপর ভবন নির্মাণ, সমিতির বহুতল মার্কেটে দোকান বরাদ্দ, লটারিতে অনিয়মসহ বহু দুর্নীতির অভিযোগ সমিতিকে কুক্ষিগত করে রাখা প্রভাবশালী ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে। একেকটি সদস্যপদ বিক্রি করা হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায়। মমতা সমবায় সমিতির প্রভাবশালী সদস্য মোখলেছুর রহমান ও বদরুল আলমসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে ছিল বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। সমবায় কর্মকর্তা মুহাম্মদ গালীব খান এ অভিযোগ উপেক্ষা করে সমিতির নির্বাচন ও নতুন কমিটির অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। দুদকের তদন্তে প্রকাশ পাচ্ছে এসব দুর্নীতির তথ্য।
এ বিষয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মোছা. ফাহমিদা আকতার বলেন, দুটি মামলায় তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। গালীব দম্পতির অবৈধ সম্পদের খোঁজ নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। একই স্থানে টানা আট বছর চাকরি করেন গালীব খান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একের পর এক বাগিয়ে নেন পদোন্নতি। সর্বশেষ তিনি ২০১৭ সালে পাঁচ সিনিয়র কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি পান তিনি। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে তার ‘মুরুব্বি’ হিসেবে রয়েছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। এ কারণে শত অপরাধেও তার বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এসব বিষয়ে সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মুহাম্মদ গালীব খান বলেন, এসব অভিযোগ সত্য না। এর চেয়ে বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য