মোতাহার হোসেন: নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ক্রমাগত বাড়ছে। বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া এবং মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতাকে এ জন্য দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এমনি অবস্থায় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও চলমান মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইন মন্ত্রণালয় থেকে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে প্রায় দুই লক্ষাধিক।
সূত্রমতে, নারী শিশুর প্রতি অ্যাসিড সন্ত্রাস, নারী বা শিশু পাচার, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌতুক, আত্মহত্যার প্ররোচনা, যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে অহরহ। কিন্তু এসব বিষয়ে থানায় মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের অনীহা, দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানির ঘটনা ঘটছে। এমনি অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হয়েও বিচার পায় না ভুক্তভোগীরা। আবার মান-সম্মানের ভয়ে অনেকেই বিষয়টি চেপে যায়। এমনি অবস্থায় আইন মন্ত্রণালয় বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সংশোধিত ২০০৩ অনুযায়ী মামলা করে দ্রুত প্রতিকারের উদ্যোগ নেয়।
সূত্র জানায়, সমাজে এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে বিচারপ্রার্থীর প্রথম কাজ হলো পার্শ্ববর্তী থানায় বিষয়টি জানানো। কোনো কারণে থানায় পুলিশ যদি মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে (বিচারিক হাকিম) আদালতে নালিশি অভিযোগের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করতে হবে।
সূত্র জানায়, নারী শিশু নির্যাতনের মামলার বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অনেক সময় বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করে। এ রকম একটি মামলা হচ্ছে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ওয়াজউদ্দিন স্কুলের সামনে থেকে ৭ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে ধর্ষণ সংক্রান্ত। এ ব্যাপারে ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ধর্ষণের শিকার শিক্ষার্থীর মা মামলাটি করেন।
কিন্তু ২৩ বছরেও সুরাহা হয়নি সেই মামলার। একই আদালতে ২০১৫ সালে কেরানীগঞ্জের এক স্কুলশিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলার শুনানি শুরু হয়। সেই মামলাটিও একইভাবে ঝুলে আছে। গত মঙ্গলবার নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৩, ৪ ও ৮ ঘুরে দেখা গেল, সেগুলোতে যথাক্রমে ৩২টি, ৩৭টি ও ৭৪টি মামলার কার্যক্রম চলছে। পাবলিক প্রসিকিউটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনই এত মামলার ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালগুলো।
সূত্র জানায়, ঢাকার নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি আদালতে গত ১০ বছরে আড়াই হাজারের মতো মামলার কার্যক্রম চলমান আছে। সাক্ষীর অভাবে মামলার জট বাঁধে বলে তারা মনে করেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা বলেন, সাক্ষীর অভাবের পাশাপাশি দীর্ঘসূত্রতা মামলাজটের অন্যতম কারণ। স্বল্প সময়ে বিচার না হওয়ায় বাড়ছে নারী নির্যাতন।
তারা বলেন, ২০১৫ সাল থেকে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে যৌন সহিংসতা। এমন বাস্তবতার মধ্যে আজ দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে ইয়াসমিন হত্যা/নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। সমাজে নারী ও শিশুদের ওপর ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দন্ড বিধির বিধানসমূহ অপর্যাপ্ত থাকায় সরকার ১৯৯৫ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ১৯৯৫’ প্রণয়ন করেন, যা সর্বশেষ ২০২০ সালে সংশোধিত হয় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ নামে অভিহিত।
পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করলে করণীয়: প্রথম যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পরেও পুলিশ মামলা গ্রহণ করছে না। এ ক্ষেত্রে সাধারণত অপরাধের শিকার ব্যক্তির বর্ণিত ঘটনা এমন থাকে যে, অপরাধ যিনি করেছেন তিনি স্থানীয়ভাবে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুলিশ গ্রহণ করছে না।
ওপরে বর্ণিত বর্ণনা অনুযায়ী কারণ বা অন্য যেকোনো কারণে হোক, কোনো অভিযোগকারী পুলিশের কাছে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার অনুরোধ করে ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হয়েছেন মর্মে হলফনামা সহকারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন অপরাধ বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট দীপ্তি সিকদার বলেন, নারী নির্যাতন, বিশেষ করে যৌন নির্যাতন বাড়ছে। এটি রোধে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে, কিন্তু বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রতার জন্য এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচার না হওয়ার কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতা।’ তিনি বলেন, অতিসম্প্রতি দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রাপ্তবয়স্ক নারীর চেয়ে শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য