-->
‘দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের অপসারণ চেয়ে আইনজীবীদের বিক্ষোভ

সর্বোচ্চ বিচারালয়ে ভিন্ন দৃশ্যের একদিন

বিচারপতি-আইনজীবীর বাগবিতণ্ডা

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
সর্বোচ্চ বিচারালয়ে ভিন্ন দৃশ্যের একদিন
দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতিদের অপসারণ দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর অভিমুখে পদযাত্রা

সুপ্রিম কোর্টের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনিয়মে’ জড়িত বিচারপতিদের অপসারণ দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ করেছেন একদল আইনজীবী। তারা প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। দাবি আদায়ে তারা আগামী ২১ অক্টোবর পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানা গেছে।

গত সাড়ে ১৫ বছরে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ করা দুর্নীতিবাজ ও দলীয়কর্মীর মতো আচরণকারী বিচারপতিদের অপসারণ দাবিতে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা। গতকাল দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সামনে থেকে এ পদযাত্রা শুরু হয়। এরপর প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বারে তারা সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। ব্যারিস্টার এম আশরাফুল ইসলামের সঞ্চালনায় সমাবেশে শতাধিক আইনজীবী অংশ নেন। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন। পরে আইনজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুপুর ২টার দিকে সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, মহসীন রশিদ, শাহ আহমেদ বাদল, সৈয়দ মামুন মাহবুব, এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার রাজা, কাজী জয়নাল আবেদীন ও জুলফিকার আলী জুনু প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক করেন।

সাক্ষাৎ শেষে হাইকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন আইনজীবী মহসীন রশিদ ও সৈয়দ মামুন মাহবুব। তারা জানান, আজ (গতকাল) মঙ্গলবার দুর্নীতিগ্রস্ত ৩০ বিচারপতির ছবি ও নাম প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতির আহ্বানে তা স্থগিত রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের দাবির যৌক্তিকতার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। প্রধান বিচারপতি সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যে সর্বোচ্চ যা করা সম্ভব অবশ্যই তা করবেন এবং তা ২০ অক্টোবরের মধ্যে দৃশ্যমান হবে।

মহসীন রশিদ বলেন, আমরা এর আগে প্রধান বিচারপতিকে ৩০ জনের একটি লিস্ট দিয়েছি। সাক্ষাতে দেখলাম এই লিস্ট উনার কাছে রাখা আছে। তিনি ওই লিস্ট আমাদের দেখিয়ে বলেছেন যে এর ওপর কাজ করছেন। সাংবিধানিক আওতায় যত কিছু করার সেটা তিনি করবেন। আমরা প্রধান বিচারপতিকে বলেছিÑ সংবিধানের ১০৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুর্নীতিবাজ ও দলবাজ বিচারপতিদের ছুটিতে পাঠানো যেতে পারে। তখন প্রধান বিচাপরতি আমাদের আশ^স্ত করে বলেছেন ২০ তারিখের মধ্যে সেটা দৃশ্যমান হবে যে প্রধান বিচারপতি কাজ করছেন।

পরে সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, ৩০ জন দলবাজ বিচারপতি পদত্যাগ না করলে দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ, তাদের নাম ও ছবি আমরা প্রকাশ করব। এই নাম আমরা গত ৭ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির কাছে দিয়েছি। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাকেও দিয়েছি। বিএনপিও দিয়েছে। সবারই একটি কমন দাবি।

এর আগে হাইকোর্ট বিভাগের চরম দুর্নীতিবাজ অযোগ্য দলকানা বিচারপতিদের ২০ অক্টোবরের মধ্যে পদত্যাগ বা অপসারণ দাবিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন আইনজীবীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বিক্ষোভ ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন তারা।

উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের ৪১ বিচারপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ তুলছেন আইনজীবীরা। এনিয়ে করা দুটি তালিকা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এই তালিকা ধরে গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক ভোরের আকাশ পত্রিকায় ‘শপথ ভঙ্গ করেছেন ৪১ বিচারপতি!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নিয়োগ পাওয়া ৪১ বিচারপতি অপসারণের দাবিতে করা দুইটি তালিকা এখন খুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরে। ওই তালিকায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন ও হাইকোর্ট বিভাগের ৪০ জন বিচারপতির নাম রয়েছে। গত ৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অনুষ্ঠিত সংলাপেও বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি স্থান পায়।

জানা গেছে, একটি তালিকায় আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি এবং হাইকোর্ট বিভাগের ২৮ জন বিচারপতিসহ মোট ২৯ জনের নাম রয়েছে। এই ২৯ বিচারপতির মধ্যে বিএনপি আমলে (২০০১ থেকে ২০০৬ সাল) নিয়োগ পাওয়া ৫ বিচারপতি এবং আওয়ামী লীগ (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল) আমলে নিয়োগ পাওয়া ২৪ জন বিচারপতির নাম রয়েছে। অপর তালিকায় হাইকোর্ট বিভাগের ২৬ জন বিচারপতির নাম রয়েছে। দ্বিতীয় তালিকার সকলেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নিয়োগ পাওয়া। উভয় তালিকায় ১৪ বিচারপতির নাম পাওয়া গেছে। ফলে দুটি তালিকায় ৫৫ জন বিচারপতির নাম থাকলেও ১৪ জনের নাম উভয় তালিকায় রয়েছে। রায় বা আদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি, অযোগ্যতা, রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলার বিচার করাসহ শপথ ভঙ্গের অভিযোগ তুলে তাদের অপসারণের দাবি করা হচ্ছে। এই তালিকা দুটি রাষ্ট্রপতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণেও আইনী জটিলতা রয়েছে। এক সময় সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান ছিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র তিন বিচারপতি নিয়ে এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হতো। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বহু বিচারপতি অপসারণের নজির রয়েছে দেশে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে। উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা নেয়া হয় জাতীয় সংসদের হাতে। এমন প্রেক্ষাপটে এক রিট মামলায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রিভিউ আবেদন করে আপিল বিভাগে; যা বিচারাধীন। এমন অবস্থায় একদল আইনজীবীর অভিমত, ষোড়শ সংশোধনীর রায় তাবিল হওয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের অভিমত এমনটাই। তবে কারও কারও অভিমত, রিভিউ আবেদন বিচারাধীন থাকায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা কার্যকর নেই। আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন যতক্ষন পর্যন্ত নিষ্পত্তি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর নেই। ফলে সুপ্রিম কোর্টের যে ৪১ বিচারক অপসারণের দাবি তোলা হয়েছে, তাদের অপসারণ নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে।’

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version