-->

যে বিচারপতিদের ছুটি শেষ হচ্ছে না

এম বদি-উজ-জামান
যে বিচারপতিদের ছুটি শেষ হচ্ছে না

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ১২ বিচারপতিকে কার্যত ছুটিতে পাঠানো হলো গতকাল বুধবার। যদিও ওই ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই বেঞ্চ না দেয়াটাই কার্যত বিচারিক কাজ থেকে ছুটিতে পাঠানো। এই ১২ বিচারপতিকে কতদিন বেঞ্চ দেয়া থেকে প্রধান বিচারপতি বিরত থাকবেন তা নিশ্চিত নয়। এরও আগে হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয়; কিন্তু তাদের ছুটি আর শেষ হচ্ছে না। গত পাঁচ বছর ধরে তারা টানা ছুটিতে আছেন।

অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছুটিতে থাকা তিনজন হলেন- বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি একে এম জহিরুল হক। অসদাচরণের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট তাদের বেঞ্চ দেয়া থেকে বিরত থাকেন সে সময়কার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এই যে শুরু হলো ওই তিন বিচারপতির ছুটি।

জানা যায়, ওই তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর সে সময়কার আপিল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলীর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটি প্রতিবেদন দিলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে ওই তিন বিচারপতি বিচার কাজে না থেকেও গত ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা নিয়মিত বেতন-ভাতা, আবাসন, যানবাহনসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি প্রতি মাসে ৯৫ হাজার টাকা মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া, অন্যান্য ভাতাসহ প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। এছাড়াও অবারিত চিকিৎসা ভাতাও পান একজন বিচারপতি।

জানা যায়, আপিল বিভাগের রায় এবং সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করবে তিন সদস্যের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সংবিধানের ৯৬(৬) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেই কেবল রাষ্ট্রপতি অপসারণ করতে পারবেন। যে ব্যবস্থা সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী পর্যন্ত বলবৎ ছিল। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বাতিল করে তদন্তের ক্ষমতা দেয় জাতীয় সংসদের হাতে। ষোড়শ সংশোধনীর এই বিধান অনুযায়ী বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করবে আইনে নির্ধারিত কমিটি। এই কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় সংসদ তার অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় সংসদ অপসারণের সিদ্ধান্ত নিলেই কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে।

১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। ২০১১ সালের ১১ মে আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে ৫ম সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়। এ অবস্থায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়; যা ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। জাতীয় সংসদকে দেয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। পরে সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবী ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানির পর রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্টের তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করে সরকার। আপিল বিভাগ ২০১৭ সালের ৩ জুলাই সরকারের আবেদন খারিজ করে রায় দেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি বলে এ রায় দেন। ওই বছরের পহেলা আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওই রায়ে উচ্চ আদালতের বিচারকরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মুখোমুখি হবেন; তারও একটি গাইডলাইন ঠিক করে দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। মোট ৩৯ দফা শর্ত দেয়া হয়েছে সেখানে। একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর রিভিউ আবেদন করে সরকারপক্ষ। দীর্ঘদিন পর চলতিবছর ওই রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানির জন্য আবেদন করে সরকারপক্ষ। এই রিভিউ আবেদন বিচারাধীন দেখিয়ে গত কয়েক বছরে আর কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন থেকে বিরত থাকেন সময়ে সময়ে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতিরা।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version