বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের ঘেরাওয়ের মুখে হাইকোর্ট বিভাগের ১২ বিচারপতিকে কার্যত বিচারিক কার্যক্রম থেকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। গতকাল বুধবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের আমন্ত্রণে চায়ের টেবিল থেকে তাদের ছুটিতে পাঠানো হলো।
সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না। গতকাল এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এই ঘোষণা দেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেঞ্চ না দেয়ার অর্থ হলো ছুটিতে পাঠানো।
এর আগে দুপুরের পর থেকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের চায়ের আমন্ত্রণে একে একে অংশ নেন হাইকোর্ট বিভাগের ওই ১২ বিচারপতি। পরে তাদের ছুটিতে পাঠানো হয়। জানা গেছে, পর্যায়ক্রমে আরও বিচারপতিদের এভাবেই ছুটিতে পাঠানো হতে পারে।
গতকাল যাদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে তারা হলেন- বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি মো. খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি আশিষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি খিজির হায়াত, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূর-উদ্দিন, বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন। এদের মধ্যে বিচারপতি আতাউর রহমান খান বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া। বাকি ১১ জন আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে ১০১ জন বিচারপতি দায়িত্বরত। এদের মধ্যে ৬ জন বিএনপি আমলে (২০০১-০৬ সাল); ৭২ জন আওয়ামী লীগ আমলে (২০০৯-২০২৪ সাল) এবং ২৩ জন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে নিয়োগ পাওয়া।
দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনিয়মে জড়িত বিচারপতিদের অপসারণের দাবিতে গতকাল বুধবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট চত্বর ছিল বিক্ষোভে বিক্ষোভে উত্তাল। আইনজীবী-ছাত্রদের খণ্ড খণ্ড মিছিল ও স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর। এদিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় করা রিভিউ আবেদনের ওপর আগামী ২০ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। এই আবেদন নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ প্রক্রিয়া নির্ধারিত হবে।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন সমন্বয়কের সঙ্গে আলোচনা শেষে গতকাল বিকেল চারটার দিকে হাইকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে বিক্ষোভস্থলে আসেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা। তিনি শিক্ষার্থী-আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের যে দাবি, আপনাদের যে লিডার, তারা আমার চেম্বারে বসেছিলেন। আমরা দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছি। পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছি। সঙ্গে দুজন সহকর্মী ছিলেন। আপনারা জানেন, বিচারপতির পদত্যাগ বা অপসারণ- এটার একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন বিদ্যমান নেই। বিগত সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। একটা সংশোধনী হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। সেটা আবার সরকার রিভিউ আকারে পেশ করেছে। আগামী রোববার ২০ অক্টোবর সেটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগে শুনানি হবে। ১ নম্বর আইটেম রাখা হয়েছে সেটি। অন্যদিকে বিচারপতিদের পদত্যাগে আপনাদের যে দাবি, বিচারপতিদের নিয়োগ কর্তা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের সেই উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয়, উনি সেটা করেছেন। জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেয়ার অর্থই হলো- তারা এই যে আগামী ২০ অক্টোবর কোর্ট খুলবে, তারা আর বিচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না। ওই মামলাটির (ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ) শুনানি আছে ২০ তারিখে। অ্যাটর্নি জেনারেল সেটি প্লেস করবেন। আশা করছি, এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হবে। আর বিচারপতি অপসারণের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট এককভাবে জড়িত নন; রাষ্ট্রপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও আইন উপদেষ্টা জড়িত আছে। আপাতত ১২ জনকে বেঞ্চ দেয়া হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে বাকিগুলো আপনাদের সামনে আসবে।’ রেজিস্ট্রার জেনারেলের এ ঘোষণার পর আন্দোলনকারীরা সুপ্রিম কোর্র্ট এলাকা ছাড়েন।
এর আগে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল বেলা ১১টার পর থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে উপস্থিত হতে থাকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজের নামে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ট্রেজারার অ্যাডভোকেট মো. কামাল হোসেন, তৌহিদুল ইসলাম, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সালমা সুলতানাসহ শতাধিক আইনজীবী বিক্ষোভে অংশ নেন। বেলা সাড়ে ১২টায় সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ’র নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি বড় মিছিল সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে প্রবেশ করে। সব মিছিল হাইকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে জড়ো হয়। সেখানে তারা সমাবেশ করেন। সেখানে সমন্বয়করা বক্তব্য দেন। তারা আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া বিচারকদের ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের পদত্যাগ দাবি করেন। সমাবেশ থেকে দুর্নীতিবাজ ও দলীয়কর্মীর মতো আচরণকারী বিচারপতিদের পদত্যাগ বা অপসারণের জন্য বেলা ২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়। এরই মধ্যে খবর প্রকাশিত হয় যে প্রধান বিচারপতি ১২ বিচারপতিকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন। এর কিছুক্ষণ পর একে একে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির দপ্তরে উপস্থিত হন। সেখানেই ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে। এরপর বিষয়টি রেজিস্ট্রার জেনারেল শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেন।
গত সাড়ে ১৫ বছরে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ করা দুর্নীতিবাজ ও দলীয়কর্মীর মতো আচরণকারী বিচারপতিদের পদত্যাগ বা অপসারণের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছেন একদল আইনজীবী। এমনকি সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের পৃথক দুটি তালিকা রাষ্ট্রপতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে দাখিল করা হয়। ওই তালিকা অনুযায়ী বিচারপতিদের পদত্যাগ বা অপসারণের দাবিতে এই আন্দোলন চলছিল। এরই মধ্যে মঙ্গলবার হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির সঙ্গে আইনজীবীর বাগবিতণ্ডা হয়। যার খবকর ছড়িয়ে পড়ে সব খানে। এর পরই বৈষম্যবিরোদী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
আগের দিন মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতির কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বারে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। পরে আইনজীবীদের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুপুর ২টার দিকে সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, মহসীন রশিদ, শাহ আহমেদ বাদল, সৈয়দ মামুন মাহবুব, এ বি এম রফিকুল হক তালুকদার রাজা, কাজী জয়নাল আবেদীন ও জুলফিকার আলী জুনু প্রধান বিচারপতির সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে সংবিধানের ১০৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দুর্নীতিবাজ ও দলবাজ বিচারপতিদের ছুটিতে পাঠানোর পরামর্শ দেন এই আইনজীবী নেতারা।
সাক্ষাৎ শেষে হাইকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন আইনজীবী মহসীন রশিদ ও সৈয়দ মামুন মাহবুব। তারা জানান, দুর্নীতিগ্রস্ত ৩০ বিচারপতির ছবি ও নাম প্রকাশ করার ঘোষণা থাকলেও প্রধান বিচারপতির আহ্বানে তা স্থগিত রাখা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের দাবির যৌক্তিকতার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। প্রধান বিচারপতি সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যে সর্বোচ্চ, যা করা সম্ভব অবশ্যই তা করবেন এবং তা ২০ অক্টোবরের মধ্যে দৃশ্যমান হবে।
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের ৪১ বিচারপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ তুলছেন আইনজীবীরা। এনিয়ে করা দুটি তালিকা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এই তালিকা ধরে গত মঙ্গলবার দৈনিক ভোরের আকাশ পত্রিকায় ‘শপথ ভঙ্গ করেছেন ৪১ বিচারপতি!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকরের আমলে নিয়োগ পাওয়া ৪১ বিচারপতি অপসারণের দাবিতে করা দুইটি তালিকা এখন খুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরে। ওই তালিকায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন ও হাইকোর্ট বিভাগের ৪০ জন বিচারপতির নাম রয়েছে। গত ৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অনুষ্ঠিত সংলাপেও বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি স্থান পায়; যা নিয়ে পরে সোচ্চার হয় সুপ্রিম কোর্টের একদল আইনজীবী।
উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণে আইনি জটিলতা রয়েছে। এক সময় সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান ছিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র তিন বিচারপতি নিয়ে এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হতো। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বহু বিচারপতি অপসারণের নজির রয়েছে দেশে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে। উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা নেয়া হয় জাতীয় সংসদের হাতে। এমন প্রেক্ষাপটে এক রিট মামলায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রিভিউ আবেদন করে আপিল বিভাগে; যা বিচারাধীন। রিভিউ আবেদন বিচারাধীন থাকায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা কার্যকর নেই। আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন যতক্ষণ পর্যন্ত নিষ্পত্তি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর নেই। ফলে সুপ্রিম কোর্টের যে ৪১ বিচারক অপসারণের দাবি তোলা হয়েছে, তাদের অপসারণ নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে। এ কারণে ওই রিভিউ আবেদনের ওপর আগামী ২০ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য