সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ নিয়ে নতুনভাবে বিতর্ক শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দৈনিক মানবজমিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই বলে মন্তব্য করায় এই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। শুধুই বিতর্ক নয়, এখন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধেই শপথ ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় সংসদের স্পিকারের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে যে সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা পূরণে প্রধান উপদেষ্টা মতামতের জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স পাঠাতে পারবেন বলেও অভিমত আইন বিশেষজ্ঞদের। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এমন অবস্থায় ওইদিন রাত ১১টা ২০ মিনিটে তিন বাহিনী প্রধানকে পেছনে দাঁড় করিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সেটি টিভিতে লাইভ সম্প্রচার করা হয়। জাতির উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) পদত্যাগপত্র প্রেরণ করেছেন। আমি তা গ্রহণ করেছি।’ এর পরদিন গত ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ৫৭(১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র পাঠালে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে। আর ৫৭(১)(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্য না থাকলে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে। আর ৫৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। ৫৭(২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ঠিক আড়াই মাস পরে এসে রাষ্ট্রপতি বলছেন শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র তার কাছে নেই। তিনি এখন তা খুঁজছেন। আর এ নিয়েই শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।
গত ১৯ অক্টোবর দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার রাজনৈতিক ম্যাগাজিন সংস্করণ ‘জনতার চোখ’- এ ‘উনি তো কিছুই বলে গেলেন না...’ শিরোনামে রাষ্ট্রপতির এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন। ওই লেখাটিতে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রপতি বলছেন, ‘আমি শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি’। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘৫ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় বঙ্গভবনে ফোন এলো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে। বলা হলো, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে আসবেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। এটা শুনেই প্রস্তুতি শুরু হলো বঙ্গভবনে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফোন এলো তিনি (শেখ হাসিনা) আসছেন না’। আলাপচারিতায় রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কিনা? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন।... সব কিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি’।”
রাষ্ট্রপতির এই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পরই তোলপাড় শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে ১৪৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির শপথ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমি----সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি-পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ বা অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন- অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।’
আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনের ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ আর গত ১৯ অক্টোবর মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য পরস্পরবিরোধী। এই দুটি বক্তব্যের মধ্যে যেকোনো একটি সত্য। অপরটি অসত্য। রাষ্ট্রপতি দুটি বক্তব্যই সত্য বা অসত্য হতে পারে না। এর একটি অসত্য হলে মো. সাহাবুদ্দিন নৈতিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারেন না। তার বক্তব্যই প্রমাণ করে তিনি মানসিকভাবে এই পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাই তার রাষ্ট্রপতির পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত। তারা বলছেন, সংবিধানের ৫৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানসিকভাবে অযোগ্য হওয়ায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ করা উচিত।
সংবিধানের ৫৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করবেন। কিন্তু এখন জাতীয় সংসদের স্পিকার নেই। তিনি আগেই পদত্যাগ করেছেন। সাংবিধানিক এই শূন্যতায় রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন- এমন প্রশ্নে আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি নিজেই নিজের কাছে পদত্যাগ করবেন। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে কে দায়িত্ব পালন করবেন সে প্রশ্নে আইনজীবীদের অভিমত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বিষয়ে মতামত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স পাঠাবেন। সুপ্রিম কোর্ট মতামত দেওয়ার পর সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন প্রধান উপদেষ্টা।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তিন বাহিনীর প্রধানকে পেছনে রেখে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি। জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) পদত্যাগপত্র দিয়েছেন এবং তিনি সেটি গ্রহণ করেছেন। এর আড়াইমাস পরে এসে তিনি কন্ট্রাডিকটরি কথা বলতে পারেন না। প্রায় আড়াই মাস পরে পদত্যাগ করেননি বলা মিথ্যাচার এবং শপথ লঙ্ঘনের সামিল। এতে তিনি তার পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন কিনা, সেটা ভেবে দেখতে হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন গতকাল প্রেসব্রিফিং-এ বলেছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতি অসত্য বলেছেন। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে এখন তার নিজেরই সরে যাওয়া উচিত। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ পড়ানোর আগে সর্বোচ্চ আদালত থেকে সাংবিধানিক ব্যাখ্যাও নেন রাষ্ট্রপতি। এখন কী উদ্দেশ্যে এ কথা বলেছেন তা বোধগম্য নয়। এর পেছনে অবশ্যই কোনো উদ্দেশ্য আছে। রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থেকে এমন কথা বলা বেমানান।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ভোরের আকাশকে বলেন, রাষ্ট্রপতি এমন বক্তব্য দিয়ে শপথ ভঙ্গ করেছেন। নৈতিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দেশে নৈরাজ্য ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির জন্যই এমনটি করেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এমন অবস্থায় তিনি নিজের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে তার চলে যাওয়া উচিত। যেমনটি মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী একজন নারী নিজেই নিজের কাছে তালাক নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে বেশ কিছু বিষয়ে শূন্যতা রয়েছে। তাই এখন কে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স পাঠিয়ে মতামত চাইতে পারেন।
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, রাষ্ট্রপতি যখন সংসদ ভেঙে দিয়েছেন তখনই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ নিশ্চিত হয়ে গেছে। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া বা না দেওয়ার কিছু নেই আর। সাংবিধানিক শূন্যতার আলাপটি অপ্রাসঙ্গিক। এখন রাষ্ট্রপতি যেটা বলছেন তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আমাদের সংবিধানে বেশ কিছু শূন্যতা রয়েছে। এখন সংসদ নেই, স্পিকার নেই। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ উঠলো। সংসদ না থাকায় রাষ্ট্রপতি পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অভিশংসনেরও সুযোগ নেই। স্পিকার না থাকায় তার কাছে পদত্যাগেরও সুযোগ নেই। এমন অবস্থায় কি হবে তা আমাদের সংবিধানে বলা নেই। একজন প্রধানমন্ত্রী দেশ থেকে পালিয়ে গেলে কি হবে সে বিষয়েও সরাসরি কিছু বলা নেই সংবিধানে। সুতরাং ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র কারণে প্রধান উপদেস্টা সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স পাঠাতে পারেন।
ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই- এটা বলার আর সুযোগ নেই। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী আছেন- এমনটিও বলার সুযোগ নেই। কারণ রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। ওইদিন থেকেই শেখ হাসিনা আর সংসদ সদস্য নন। আর এ কারণেই তিনি আর প্রধানমন্ত্রীও নন। রাষ্ট্রপতির কার্যবিধির মাধ্যমে শেখ হাসিনার পদত্যাগ সম্পন্ন হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে এ ধরনের কথা বলা অশনিসংকেত।
এর আগে গত ১০ আগস্ট শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। জয় বলেন, ‘তিনি একটি বিবৃতি দিয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে শুরু করে। সময় ছিল না। তিনি ব্যাগ গোছানোর সময়টুকুও পাননি। যতদূর জানি, সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য