-->

তারেক রহমানসহ সব আসামি খালাস

এম বদি-উজ-জামান
তারেক রহমানসহ সব আসামি খালাস

বহুল আলোচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় (ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল) নিম্ন আদালতের রায় বেআইনি, কর্তৃত্ব বহির্ভূত ও বাতিল বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে এ মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ সকল আসমি খালাস পেয়েছেন।

বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোববার দুপুরে এই রায় ঘোষণা করেন। এক জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণা করা হয়। আদালত বলেছেন, বিরোধী দলীয় নেত্রীর সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু ট্রাজিক ঘটনা। কিন্তু অধিকতর তদন্ত, মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সীর দ্বিতীয়দফার জবানবন্দি, অধিকতর তদন্ত শেষে দ্বিতীয়দফা অভিযোগপত্র দাখিলের প্রক্রিয়াসহ নিম্ন আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ার সবকিছুই ছিলো বেআইনি। গতকাল এই রায় ঘোষণার পরপরই আদালতের বারান্দায় থাকা ব্যক্তিরা আনন্দ উল্লাস করেন। জানা গেছে, নেত্রকোণা-টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন স্থানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় পৃথক দুই মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা) আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন), আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষে এই রায় দেওয়া হয়। হাইকোর্ট প্রধানত তিন কারণে নিম্ন আদালতের রায় বেআইনি ও বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন। এসময় আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান, ব্যারিস্টার মো. সারোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ শিশির মনিরসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিএনপিপন্থি আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামালসহ কয়েকশ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। রায় শুনতে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবনী, ছেলে লাবিব ইবনে জামান, পিন্টুর ভাই ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুসহ আরও অনেকে।

হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, একই মামলায় একজন আসামি দুইবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে পারেন কিনা এবং সেটি আইনগতভাবে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য কিনা? উত্তর হচ্ছে- একজন আসামির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দির ভিত্তিতে একবার চার্জশিট দাখিলের পর তা আমলে নিয়ে বিচার কাজ শুরু হলে একই আসামির দ্বিতীয়দফা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া বেআইনি। এই মামলায় সেই বেআইনিভাবেই মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। এই আসামি আদালতে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেননি। তাকে নির্যাতন করে ঘটনার সঙ্গে নিজেকে ও অন্যদের জড়িয়ে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে, যা আইনের দৃষ্টিতে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

রায়ে বলা হয়, প্রশ্ন হলো প্রথম চার্জশিট আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠনের পর ৬১ জন জনের সাক্ষ্য নেওয়া হলো। এরপর নতুন করে তদন্তের সুযোগ আছে কিনা? উত্তর হলো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এজন্য আদালতে আবেদন দিতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যপ্তয় ঘটেছে। তদন্ত কর্মকর্তা অধিকতর তদন্তের জন্য কোনো আবেদন দেননি। কিন্তু পিপি আবেদন দিয়েছেন যা বেআইনি। এই বেআইনি আবেদনের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেওয়া বেআইনি হয়েছে। এই বেআইনি আদেশের পর অধিকতর তদন্ত শেষে আগের অনেক কিছু বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করে দ্বিতীয়দফা অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, যা বেআইনি।

রায়ে বলা হয়, আইন অনুযায়ী কোনো মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করার কথা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে তা বিচোরের জন্য বিচারিক আদালত তথা দায়রা আদালতে পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু আলোচিত এই মামলায় দ্বিতীয় দফায় অধিকতর তদন্ত শেষে দেওয়া দ্বিতীয় অভিযোগপত্র ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল করা হয়নি। তা সরাসরি দায়রা জজ আদালতে তথা বিচারিক আদালতে দাখিল করা হয়, যা বেআইনি। এই বেআইনি পথে দাখিল করা অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে বিচার কাজ পরিচালনা করাও বেআইনি ও কর্তৃত্ব বহির্ভূত। আলোচিত এই মামলায় তাই-ই হয়েছে।

রায়ে বলা হয়, আইন অনুযায়ী ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি হতে হবে স্বেচ্ছামূলক ও সত্য। কিন্তু এই মামলায় যারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তারা সকলেই বলেছেন তাদেও ওপর নির্যাতন চালিয়ে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা বলেছেন, টাস্কফোর্স ইনটেলিজেন্স (টিএফআই) সেলে নিয়ে তাদের সেখানে অসংখ্য দিন আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, যা বেআইনি। তাছাড়া আইনের কোথাও টিএফআই সেলের অস্তিত্ব নেই। এই টিএফআই সেল গঠণের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।

রায়ে বলা হয়, ফৌজদারি মামলায় সাজা দিতে হয় তথ্য-প্রমাণ, অকাট্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে। আলোচিত এই মামলায় যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তা ট্রাজেডিক (বেদনাদায়ক)। কিন্তু ওই ঘটনায় কে বা কারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। তদন্ত কর্মকর্তা গ্রেনেড নিক্ষেপকারী আসামিকেও খুঁজে পাননি। এছাড়া এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং সাজা দেওয়া হয়েছে, তাও আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা ও ব্যবসায়ী মোবাইল কাদের হত্যা মামলার ষড়যন্ত্র প্রমানের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, সাক্ষ্য আইনের ১০ ধারায় আসামিদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সাজা দিতে হলে যথাযথ নথি (ডকুমেন্ট), মৌখিক বা পারিপার্শিক সাক্ষ্য থাকতে হবে। কিন্তু আলোচিত এই মামলায় তা অনুপস্থিত। ফলে এই মামলায় ১০ ধারায় সাজা দেওয়া যথাযথ হয়নি।

রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, নিম্ন আদালতের রায় ও বিচারিক প্রক্রিয়া বেআইনি ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একারণে মামলার সকল আসামি খালাস পেয়েছেন। নিম্ন আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়া অবৈধ ও বাতিল হওয়ায় তারেক রহমান, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ যেসব আসামি আপিল করেননি তারাও সুবিধা পেয়েছেন।

রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী ও উপস্থিত আত্মীয়স্বজনরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, হাইকোর্টের এই রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা বলেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তারেক রহমান, বাবরসহ সংশ্লিষ্টদের আসামি বানিয়ে সাজা দেওয়া হয়েছিল।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছেন, খালাসের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা উচিত। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা দেখে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান বলেছেন, এই মামলার দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়। কার্যত একজন আসামির (মুফতি আব্দুল হান্নান) স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ভিত্তিতে তাদের আসামি করা হয়েছে। আইনগতভাবে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া অভিযোগপত্র ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু এ মামলায় দ্বিতীয়দফা যে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় তা সরাসরি দায়রা জজ আদালতে দাখিল করা হয়। সে জন্য এই অভিযোগপত্র ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী গৃহীত হতে পারে না। উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগের নজির আছে যে, যদি দেখা যায় পুরো মামলায় অভিযোগ কোনো আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়নি ও যথাযথভাবে তদন্ত হয়নি, সে ক্ষেত্রে সব আসামি খালাস পেলে যারা আপিল করেননি, ওই রায়ের সুবিধা তারাও পেতে পারেন। একারণে তারেক রহমান ও কায়কোবাদসহ যেসব আসামিরা আপিল করতে পারেননি, তারাও সুবিধা পেয়েছেন।

লুৎফুজ্জামান বাবরসহ তিন আসামির আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, এই মামলায় প্রথমদফা অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে মামলার বিচার শুরু হয়। দায়রা জজ আদালতে ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হয়। এরপর একজন আসামিকে নির্যাতন চালিয়ে তার কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়। ওই আসামি পরে তা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে বলেন, তাকে অত্যাচার করে জবাবনবন্দি নেওয়া হয়েছে। এমনকি আইন অনুযায়ী অভিযোগপত্র ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল করার নিয়ম থাকলেও এই মামলায় সরাসরি দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় এবং ওই অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বেআইনিভাবে তারেক রহমান, বাবরসহ ৩০ জন আসামিকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এই আইনজীবী বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের ৪শ বছরের ইাতহাসে এমন একটি মামলাও পাওয়া যাবে না যেখানে একবার মামলার বিচার শুরু হয়ে যাবার পর সরাসরি দায়রা জজ আদালতে দ্বিতীয়দফা অভিযোগপত্র দাখিলের মাধ্যমে তার ওপর ভিত্তি করে কোনো আসামিকে সাজা দেওয়া হয়েছে বা বিচার করা হয়েছে। যা বেআইনি। একারণেই তারেক রহমান বা বাবরসহ আসামিরা খালাস পেয়েছেন। তিনি বলেন, তারেক রহমান আপিল না করলেও আইনের ক্রুটির কারণেই এর সুবিধা পেয়েছেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হতাহতের ঘটনায় দুই দিন পর ২৩ আগস্ট মতিঝিল থানায় পৃথক চারটি মামলা হয়। আওয়ামীলীগের সেসময়কার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, সাবের হোসেন চৌধুরী ও বাহাউদ্দিন নাসিম পৃথক তিনটি মামলা করেন। আর মতিঝিল থানার সেসময়কার এসআই শরিফ ফারুক আহমেদ আরেকটি মামলা করেন। তদন্তকালে ২০০৭ সালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সী। ১৬১ ধারায় তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি তারেক রহমানকে জড়িয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। এই চার মামলায় একসঙ্গে তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৯ জুন দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনে দুটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এভাবেই দাঁড়িয়ে যায় পৃথক দুই মামলা। উভয় মামলায় আসামি করা হয় ২৮ জন করে। এই অভিযোগপত্রে তারেক রহমান বা লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ বেশ কয়েকজন আসামি ছিলেন না। এই অভিযোগপত্র ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আমলে নিয়ে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে বিচারের জন্য দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ৬১জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়। এমন অবস্থায় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন শেখ হাসিনার সরকার। এর কয়েকমাস পর একইবছরের ২৫ জুন অধিকতর তদন্ত চেয়ে বিচারিক আদালতে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি)। আইন অনুযায়ী অধিকতর তদন্তের আবেদন করার দায়িত্ব তদন্ত কর্মকর্তার। পিপির আবেদনে একই বছরের ৩ আগস্ট এক আদেশে অধিকতর তদন্তের অনুমতি দেয় আদালত। এরপর ১২ আগস্ট তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় আব্দুল কাহহার আকন্দকে। কাহহার আকন্দ দায়িত্ব পেয়ে মুফতি হান্নানকে ফের রিমান্ডে নেয়। এর কয়েকদিন ১৬৪ ধারায় দ্বিতীয়দফা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মুফতি হান্নান। এবার তার জবানবন্দিতে তারেক রহমান, বাবরসহ আরো অনেকের নাম জড়ানো হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২ জুলাই তারেক রহমান, বাবরসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় বিচারিক আদালতে। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল না করে সরাসরি বিচারিক (দায়রা জজ) আদালতে দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত এই অভিযোগপত্র ২০১১ সালের ২৫ আগস্ট আমলে নিয়ে আসামিদের বিচার শুরু করেন। এ পর্যায়ে মুফতি হান্নান তার ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য লিখিত আবেদন দেন। তিনি আবেদনের বলেন, তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে এ ধরনের জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন(পরবর্তীতে হাইকোর্টের বিচারপতি) ওই আবেদন খারিজ করে বিচার কাজ অব্যাহত রাখেন। বিচার কালে আদালত মোট ২২৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, কারাবন্দি আসামিপক্ষের আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদেও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর আলোচিত এ মামলায় রায় দেন। রায়ে হত্যা মামলায় বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১১ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায়ও অভিন্ন আসামিদের অভিন্ন সাজা দেওয়া হয়। এই রায়ের একবছর পর ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় শাহেদ নুরউদ্দিনকে। আর তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দকে কিশোরগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পান।

এই মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা অনুমোদনের জন্য ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। এটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের জেল আপিল, নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। ডেথ রেফারেন্স এবং এসব আপিল ও আবেদনের ওপর সাধারণত একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিপক্ষে আপিল করার পর পেপারবুক তৈরির পর ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্টে পাঠানো হয়। দুটি মামলায় প্রায় ২২ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক হাতে পাবার পর মামলাটি(ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল) হাইকোর্টে শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবীও নিয়োগ শেষে বেশ কয়েকবছর এই মামলা শুনানির জন্য অপেক্ষায় ছিল। বেশ কয়েকবছর এমন অবস্থায় থাকার পর সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। এরপর গত ৩১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়ে ২১ নভেম্বর শুনানি সম্পন্ন হয়। সেদিন আদালত মামলা দুটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল রায় ঘোষনা করা হলো।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয়। আর তখনকার বিরোদীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ অনেকে আহত হন। এ ঘটনার পর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। এই হামলার ঘটনায় ওই কমিশন প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সদস্যদের জড়িত থাকার তথ্য তুলে ধরেন। এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এই মামলায় জজ মিয়া নামক এক আসামির ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি নিয়ে পরে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিএনপি সরকারের বিদায়ের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ‘জজ মিয়া নাটক’ নামে ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরে ওই জজ মিয়া অভিযোগ করেন তার ওপর অত্যাচার চালিয়ে পুলিশ জবানবন্দি আদায় করেছে। একারণে আওয়ামী লীগ সরকার ওই জজ মিয়াকে ব্যাপকভাবে আর্থিক সহায়তা দেয়।

মামলায় প্রথম অভিযোগপত্রে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অধিকতর তদন্ত হয়। আওয়ামীলীগ সরকার মুফতি আব্দুল হান্নানের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তার কাছ থেকে কথিত জবানবন্দি আদায় করে তার ভিত্তিতে তারেক রহমান, বাবরসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। এরপর বিচার শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ে হত্যা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়া) রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী (বর্তমানে প্রয়াত) ও সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় অভিন্ন আসামিদের অভিন্ন সাজা দেওয়া হয়।

এখনও যেসব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় পৃথক দুই মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা) তারেক রহমান হাইকোর্ট থেকে খালাস পেলেও তার আরও চার মামলায় সাজা রয়েছে। এগুলো হলো-

এক. বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর একটি মামলায় ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেন। ওই মামলায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাইকোর্টে আপিল করেন। ওই আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। এই মামলায় তারেক রহমানকে খালাস দেওয়ায় নিম্ন আদালতের বিচারক মোতাহার হোসেনকে দেশ ছাড়তে হয়। বিচারক মোতাহার হোসেনের অভিযোগ, হাইকোর্টের এক বিচারপতির বাসভবনে তাকে ডেকে নিয়ে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তারেক রহমানকে সাজা দিতে বলা হয়েছিল।

দুই. জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এক রায়ে তারেক রহমানকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়। এই মামলায় তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে দুদকের আপিলে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট, যা আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

তিন. জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবে সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগের মামলায় গতবছর ২ আগস্ট ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে ৯ বছর ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে ৩ বছর কারাদণ্ড দেয়।

চার. ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার ও পাকবন্ধু আখ্যা দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে নড়াইলের মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বিশ্বাস নড়াইল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তারেকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। এই মামলায় নড়াইলের একটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়।

২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেই তারেকের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলার সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৮০টি মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় সকল গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, যা গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রত্যাহার করা হয়।

এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডেও নেওয়া হয়। ১৮ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান তিনি। ওই ১৮ মাসে ১৩ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তারেককে। ১৩ মামলায় ধাপে ধাপে তাকে জামিন দেওয়া হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আট দিন পর ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেই থেকে তিনি লন্ডনেই আছেন।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version