-->

ভালোবাসার ইতিকথা

শারমিন লিমা
ভালোবাসার ইতিকথা
প্রতীকী ছবি

প্রিয় মানুষের প্রতি ভালোবাসা মহাকালের শুরু থেকে। যার কোনো শেষ বা বিনাশ নেই। ভালোবাসা আপেক্ষিক। যার সংজ্ঞা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভালোবাসা নিজ শব্দগুণেই চিরন্তন। মানুষের ভালোবাসা প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিদিন, প্রতিটি কাজে চলমান। ভালোবাসা নির্দিষ্ট কোনো দিনে আবদ্ধ থাকে না।

হয়তো ভালোবাসাকে নতুনরূপে, ভালোবাসা পেতে চাওয়ার গভীর অনুভব থেকে জন্ম নিয়েছে ভালোবাসা দিবস। প্রিয় মানুষটি এই দিবসে একটু বেশি ভালোবাসুক- সেই চাওয়া থেকে উদযাপিত হয় ভালোবাসা দিবস। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, ‘ভালোবাসা বিশেষ সাত দিনের জন্য নয়। সারাবছর, সারাদিন ভালোবাসার। তবে আজকের এ দিনটি ভালোবাসা দিবস হিসেবে বেছে নিয়েছে মানুষ। ’

অন্যদিকে আজকের এ ভালোবাসা শুধুই প্রেমিক আর প্রেমিকার জন্য নয়। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, প্রিয় সন্তান, এমনকি বন্ধুর জন্যও ভালোবাসার জয়গানে আপ্লুত হতে পারে সবাই। চলবে উপহার দেওয়া-নেওয়া।আজ আমরা যে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করছি, তার পেছনে রয়েছে নানা ইতিহাস। এই ইতিহাসের মধ্যে কিছু মতপার্থক্যও রয়েছে।

প্রথম

প্রায় সাড়ে ১৭শ বছর পূর্বের একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। ২৭০ সালের তখনকার দিনে ইতালির রোমে শাসন করতেন রাজা দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। তখন রাজ্যে চলছিল সুশাসনের অভাব, আইনের অপশাসন, অপশিক্ষা। রাজা তার সুশাসন ফিরিয়ে আনার জন্য রাজদরবারে তরুণ যুবকদের নিয়োগ দিলেন। আর দায়িত্বশীল ও সাহসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি রাজ্যে যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন।

বিয়ে নিষিদ্ধ করায় পুরো রাজ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এ সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক জনৈক যাজক গোপনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন। তিনি পরিচিতি পেলেন ‘ভালবাসার বন্ধু বা ‘Friend of Lovers’ নামে। রাজার নির্দেশ অমান্য করার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে তাকে আটক করা হয়।

জেলে থাকাকালে ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় হয় জেলরক্ষক আস্ট্রেরিয়াসের সঙ্গে। আস্ট্রেরিয়াস জানত ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে। তিনি তাকে অনুরোধ করেন তার অন্ধ মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে। ভ্যালেন্টাইন পরে মেয়েটির দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। এতে মেয়েটির সঙ্গে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

এতে রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডের আগে ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীদের কাছে একটি কলম ও কাগজ চান।

তিনি মেয়েটির কাছে একটি গোপন চিঠি লেখেন এবং শেষাংশে বিদায় সম্ভাষণে লেখা হয় ‘From your Valentine’ এটি ছিল এমন একটি শব্দ, যা হৃদয়কে বিষাদগ্রস্ত করে। অতঃপর ১৪ ফেব্রুয়াররি, ২৭০ খ্রিস্টাব্দ ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেই থেকে সারাবিশ্বে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ উদযাপিত হয়ে আসছে।

দ্বিতীয়

সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কারারুদ্ধ করার পর প্রেমাসক্ত তরুণ-তরুণীরা প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত। উপহার দিত ফুল। তারা বিভিন্ন ধরনের কথা বলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উদ্দীপ্ত রাখত। এদের মধ্যে এক কারারক্ষীর অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। তারা দুজন প্রাণ খুলে কথা বলত। এভাবে এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যায়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় অন্ধ মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসা ও তার প্রতি দেশের যুবক-যুবতীদের ভালোবাসার কথা সম্রাটের কানে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

তৃতীয়

খ্রিস্টীয় ইতিহাসমতে, ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের কথা। সাম্রাজ্যবাদী, রক্তপিপাসু রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের দরকার এক বিশাল সৈন্যবাহিনীর। সম্রাট লক্ষ করলেন যে, অবিবাহিত যুবকরা যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে অত্যধিক ধৈর্যশীল হয়। ফলে তিনি যুবকদের বিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তার এ ঘোষণায় দেশের তরুণ-তরুণীরা ক্ষেপে যায়। যুবক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক ধর্মযাজকও সম্রাটের এ নিষেধাজ্ঞা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।

প্রথমে তিনি সেন্ট মারিয়াসকে ভালোবেসে বিয়ের মাধ্যমে রাজার আজ্ঞাকে প্রত্যাখ্যান করেন। আর গির্জায় গোপনে বিয়ে পড়ানোর কাজও চালাতে থাকেন। একটি রুমে বর-বধূ বসিয়ে মোমবাতির স্বল্প আলোয় ভ্যালেন্টাইন ফিস ফিস করে বিয়ের মন্ত্র পড়াতেন। বিষয়টি সম্রাট ক্লডিয়াসের কানে গেলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনকে হত্যার আদেশ দেন।

বাংলাদেশে যখন থেকে

১৯৯৩ সালের দিকে বাংলাদেশে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে। ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসেবে পরিচিত ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে প্রথম পালিত হয় ‘যায়যায় দিন’ পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমানের মাধ্যমে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে তার অফিসের সামনে একটি সড়কের নামকরণও করেন ‘লাভ লেন’। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়ায় প্রচারে একমাত্র তিনিই সরব ছিলেন। পরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’।

বহু প্রতীক্ষিত তিল তিল করে জমানো ভালোবাসাকে ভালো লাগার প্রিয় মানুষটার সঙ্গে শেয়ার করার দিন। ভালোবাসার মানুষটিকে যুগ যুগ ধরে পবিত্র সম্মানে সম্মানিত করা। আমরা মানুষ হিসেবে সব ভালোকে ভালোবাসি বলেই ভালোবাসার মধ্যে আছি। আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আদর-অনাদরে পড়ে থাকা মানুষগুলোর কথা ভাবার বড় প্রয়োজন।

মন্তব্য

Beta version