-->
শিরোনাম

অনলাইন প্লাটফর্মে নারীর স্বনির্ভরতা

ইসমত জেরিন স্মিতা
অনলাইন প্লাটফর্মে নারীর স্বনির্ভরতা
উদ্যোক্তা শারমীর মোস্তাফি কনি

লিঙ্গ সমতার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে পালিত হয় এই দিনটি।

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে রইল সব নারীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

বৈষম্য ভুলে নারীর ক্ষমতায়নকে সাদরে গ্রহণ করছে পৃথিবী। কিন্তু তবুও তো নারীর চলার পথটা অতটা মসৃণ নয়। যেখানে এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘টেকসই আগামীর পূর্বশর্ত লিঙ্গ সমতা’। নারী শ্রমিকের মজুরি নিয়ে এখনো তো কথা বলতে হয়। সেখানে আসেনি সমতা। নারী ধর্ষণ যেন আইন-আদালতের নিয়মিত চর্চিত একটি বিষয়। সব ক্ষেত্রে কি আমরা সমতা আনতে পারছি।

১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নামেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকারি বাহিনীর দমন-পীড়ন। পরে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন। ক্লারা জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন।

এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলা আন্দোলন আর সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯১১ সাল থেকে একটি দিন নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। পরে ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে।

বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালে এসে ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। সেই থেকে বিশ^ব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

শ্রম এবং মজুরির বৈষম্য যেখানে চড়াও, সেখানে নারীরা থেমে নেই কোনো কিছুতে। নারীদের স্বনির্ভরতার জায়গা তৈরি হয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তারা হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। নিজের স্বনির্ভরতার পাশাপাশি পরিচালনা করছেন সংসারও।

আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াসে তাই আজ কয়েকজন নারী উদ্যোক্তাকে আমরা তুলে ধরছি। যারা নিয়মিত সামাজিক মাধ্যমে গ্রাহককে পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের পছন্দের পণ্য। একই সঙ্গে পরিচালনা করছেন পরিবার, সন্তান এবং সামাজিক অবস্থান। বিস্তারিত লিখেছেন ইসমত জেরিন স্মিতা

বিশ্বজুড়ে আমাদের ক্রেতা রয়েছে 

শারমীন মোস্তাফি কনি (নারী উদ্যোক্তা ও উপস্থাপক, স্বত্বাধিকারী- ফ্যাশনিস্তা)

পুরোদস্তুর সংসারি মানুষ আমি পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা। পড়ালেখা করেছি পটুয়াখালীর একটি কলেজ থেকে। এরপর মাস্টার্স করেছি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের দর্শন বিভাগ থেকে। লেখাপড়া শেষ করে একসময় চাকরিও করতাম কিন্তু পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দেই। চাকরিটা করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু করতে পারিনি। আমার স্বামী হাবিবুর রহমান খান মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থাকতেন।

আমিও তার সঙ্গে দেশের বাইরে বেশ কয়েক বছর সময় কাটিয়েছি। এছাড়া পরিবারকে সময় দেওয়ার ব্যাপার। সবমিলিয়ে চাকরিটা আর করতে পারিনি। ব্যবসা শুরু করব এরকম ইচ্ছে ছিল না কিন্তু ছোটবেলা থেকে ক্রিয়েটিভ কিছু করার ইচ্ছে ছিল অনেক। ঝোক ছিল নিজস্ব কিছু করার।

অস্ট্রেলিয়ায় থাকা আমার এক বন্ধু শাওন আমার ব্যবহৃত পোশাক দেখে আগ্রহ দেখায় আমি যেন তাকে ওই ধরনের বেশ কিছু পোশাক বানিয়ে দেই। ওই সময় আমাকে ৩০-৪০ হাজার টাকা দিয়েছিল সে। সেই টাকা দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক বানাই এবং তাদের পার্সেল করে পাঠিয়ে দেই। তারা পোশাক দেখে এত খুশি হয় যে, সবগুলো ড্রেসই সবাই খুব পছন্দ করে এবং আরো অর্ডার দেয়। সেই থেকেই আগ্রহ শুরু।

একটা ভাল টেইলর ছিল যেকোনো ডিজাইন বললেই করতে পারত এবং আশপাশের সবাইকে ড্রেস বানিয়ে দিতাম সবাই আবার অর্ডারও দিত। এভাবেই কালেকশন বাড়াই, বিভিন্ন মেলা করি। কিন্তু বাইরের মাস্টার কারিগরদের যে মজুর সেটা অনেক বেশি তাই অনেকদিন থেকেই নিজস্ব ফ্যাক্টরি করার ইচ্ছে ছিল। ইনশাআল্লাহ এখন সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আর ড্রেস এবং শাড়ি এখন সময়মতো সবার হাতে তুলে দিতে পারব ভেবেই খুবই ভাল লাগছে।

আমি মসলিন নিয়ে বেশি কাজ করি। এসএমই মেলাতে আমার মসলিম ড্রেস সবাই খুব পছন্দ করে। অর্ডার দেয়। এছাড়া আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই আমাকে উৎসাহ দিয়ে আসছে শুরু থেকেই, যার জন্য সবার কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। কাজ করছি ৭/৮ বছর ধরে। আগে অনেক মেলা করতাম যখন শপ ছিল না।

উত্তরায় আমার শোরুম এবং ফ্যাক্টরি এখন উত্তরা বেলি কমপ্লেক্সে। এখন অনলাইন অর্ডারের কাজই বেশি আমাদের। করোনার পর থেকে কানাডা, ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন কুইন্সল্যান্ড এ আমাদের প্রডাক্টস নিয়মিত যায়। সারাবিশ্বেই আমাদের ক্রেতা রয়েছে।

এটা এখন শুধু ব্যবসা নয়, এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে বেশকিছু মানুষের। ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন ৮/১০ জন কর্মী। যারা ক্রেতাদের চাহিদামতো পোশাক সরবরাহ করতে সহায়তা করেন। এছাড়া অনিয়মিত আরো বেশকিছু কর্মী আছে যখন কাজের চাপ বেশি থাকে তখন তাদের কাজ দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে, কর্মদক্ষ লোক পাওয়া খুব দুষ্কর। দক্ষ যারা আছেন তাদের পারিশ্রমিক বেশি। আর পারিশ্রমিক বেশি হওয়ায় প্রোডাকশন খরচও বেশি পড়ে কিন্তু কাস্টমার সেটা বুঝতে চায় না, তারা ইন্ডিয়ান এবং পাকিস্তানি ড্রেসের উদাহরণ যখন দেয় তখন খারাপ লাগে।

ব্যবসা করার বেলায় প্রশিক্ষণও দরকার পড়ে। কারণ নিজে আগে দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। বিজিএমই থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে কোর্স করেছি। এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে কোর্স করেছি। এমব্রয়ডারি কোর্সও করেছি, এফ কমার্স কোর্সসহ অনেক ধরনের ট্রেনিং নিয়েছি। আমার শপ এ ক্যাজুয়াল পোশাকের পাশাপাশি রয়েছে মসলিনের বিশাল কালেকশন।

সময়গুলো শুধু ব্যবসার জন্য নয়, পরিবারের জন্যও বরাদ্দ রাখতে হয়। আমি একজন উদ্যোক্তার পাশাপাশি আমার আরেকটি পরিচয় আমি একজন মা। সুতরাং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো সংসারটাকেও আগলে রাখি, ছেলে-মেয়েদের সময় দিতে হয়।

তবে এগিয়ে চলার পথ এতটা সহজ ছিল না। কিন্তু আমি লেগে ছিলাম, হতাশ হইনি কখনো। ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে সরকারিভাবে আমি দুটো প্লট পাই। ব্যবসার প্রয়োজনে আমি একটা প্লট বিক্রি করি ৪ লাখ টাকায়। ওই টাকা দিয়েই ব্যবসাটি শুরু করি।

বর্তমানে উত্তরার পাশাপাশি আরেকটি শোরুম নেওয়ার চিন্তা করছি। নিজের অবস্থান থেকে নিজে ভালো আছি। শুধু একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নয়, বেতারের একজন উপস্থাপক হিসেবেও কাজ করছি। ২০০৬ সাল থেকে আমি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন উত্তরণসহ অনেক অনুষ্ঠান করেছি এছাড়া সংবাদ পাঠও করি।

নিজের ব্যবসার পাশাপাশি এই কাজটি যোগায় মনের খোরাক। বাংলাদেশ বেতারের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে সকল অ্যানাউন্সারদের জন্য ১০০টির মতো শাড়ির ডিজাইন করেছিলাম আমি। এই কাজটি ছিল খুবই আনন্দের। এখানেও বেশ প্রশংসা পেয়েছি।

একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে উদ্যোক্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন এন্টারপ্রাইনার অবি এর সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এই সংগঠনের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করি সবাইকে সহযোগিতা করতে।

নারীদের প্রতিষ্ঠিত হতে হলে নানানরকম সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যেতে হয় এবং হবে। কিন্তু সেটা অতিক্রম তাকে নিজেকেই করতে হবে, কখনোই হতাশ হওয়া যাবে না। আমি চাই আমার এখানে কর্মসংস্থান হোক আরো অনেকের, এছাড়াও আমি চাই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আমার এই উদ্যোগ পা রাখুক আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সীমানায়।

নারীর পথটা কণ্টকমুক্ত না

নাদিয়া আফরীন (উদ্যোক্তা - নয়লি)

আমি নাদিয়া আফরীন। আমার ছোট উদ্যোগটির নাম দিয়েছি ঘড়ুষর, শুনতে যদিও শব্দটি ইংলিশ শোনায় তবে এটি কিন্তু একটি পুরোদস্তুর বাংলা শব্দ। নয়লি অর্থ নব বা নতুন বা প্রথম। দেশিয় সকল ঐতিহ্যকে হাল ফ্যাশনের সঙ্গে মিলিয়ে আধুনিক রূপ দেয়ার একটি চেষ্টা থেকেই মূলত আমার যাত্রা শুরু করি এবং নামটাও সেই একই কারণে রাখা।

২০১৮ সালের শেষ দিকে মাত্র ১৫০০ টাকা পুঁজির বিনিময়ে পথ চলা শুরু হয় নয়লির। সেই থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলছে আমার স্বপ্ন যাত্রা নয়লি।

ছোট বেলা থেকেই দেশপ্রেম ব্যাপারটা মনে গেঁথে ছিল। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার মেয়ে হওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন কৃষ্টিগুলো কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি। ভালো লাগাটা সেই থেকেই শুরু। বড় হতে হতে ধীরে ধীরে দেখেছি আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের কুটির শিল্পগুলোর জরাজীর্ণ দশা। নায্য মজুরির অভাবে তারা তাদের পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। সেখান থেকেই মূলত তাদের নিয়ে কাজ করার একটি বাসনা তৈরি হয়।

কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধিশালী জাতি আমরা। কিন্তু কিছু অপসংস্কৃতি এবং নিজস্বতার ঠিকমতো লালন পালন না করাতে আমরা যেন নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে ফেলছি। তাই বিশ্বময় আমাদের প্রতিটি স্বাক্ষরিত সমস্ত পণ্যগুলো ছড়িয়ে দিতে চাই। স্বপ্ন দেখি আমাদের গার্মেন্ট আইটেম গুলোর মতো একদিন আমাদের খাদি, মসলিন, সিল্ক বস্ত্রগুলোও স্থান পাবে বিদেশিদের পড়নে। সেখানে থাকবে আমাদের দক্ষ কারিগরদের সুনিপুণ হাতের কাজ অথবা আঁকিয়েদের চিত্রকর্ম।

ইচ্ছে আছে চামড়া, মাটি, পাট, বেতসহ সকল ঐতিহ্য যা কিনা মিশে আছে বাঙালির রক্তে, সেসকল ঐতিহ্য একদিন রাজত্ব করবে পৃথিবীময়। সাথে হাজারো বছর বেঁচে থাকবে বিলুপ্ত প্রায় পেশাগুলো। কুমার, তাঁতি, সুঁচ্কর্মি, চিত্রশিল্পী, কুটির শিল্পের কর্মীরা। গ্রামীণ নারীরা ফিরে পাবে তাদের হারিয়া যাওয়া জীবন। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো হয় ওঠবে এক একটি স্মারক।

আমার এই পথ চলায় যারা সঙ্গ দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। কিন্তু আরো দশ/বিশ জন নারীর মতো আমার এই পথটাও কণ্টকমুক্ত নয়। পারিবারিক বাঁধা, সহযোগিতার অভাব, সর্বোপরি বিনিয়োগের অভাব। সব মিলিয়ে প্রতিটি পদে আছে চোরাবালি তবুও সৃষ্টিকর্তার রহমত আর আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে গত তিন বছরে তিল তিল করে নিজেকে দাঁড় করানোর যুদ্ধ করছি বা করতে পারছি। ভেঙ্গে পড়িনি বা ভেঙে পড়ব না, এটাই নীতি। কাজের মাধ্যমেই জবাব দিয়েছি প্রতিটি অযাচিত প্রশ্নের।

ছোট্ট হলেও আজ নয়লি একটি ব্র্যান্ড। যতটুকু পরিচিতি আছে ততটুকুতে সবাই জানে নয়লি মানে ভিন্ন কিছু, নয়লি মানে নতুন কিছু। এখানকার প্রতিটি পণ্য তৈরি হয় সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে। নিজস্ব চিন্তা ভাবনার ফসল। প্রায় ৩০ জন কর্মীর ঘাম মিশে আছে নয়লির সাথে। তাদের সুখ দুঃখের গল্প জড়িয়ে আছে প্রতিটি পরতে।

আমাদের বর্তমান সরকার যথেষ্ট পরিমাণে নারীবান্ধব। সেক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা তো আছেই। যদিও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার পথটা অনেক দীর্ঘ এবং কঠিন। ব্যাংক ঋণগুলোতে আছে উচ্চ সুদ এবং অনেক শর্ত। যেই শর্তসমূহ পার করে এই সুবিধা ভোগ করা বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে যায়। তার ওপর পরিমাণটাও যথেষ্ট নয়। ব্যাংক ঋণ এবং প্রণোদনার পথটা আরেকটু মসৃণ হওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। আমি নিজেও এখন পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাইনি ব্যাংক অথবা সরকারি তহবিল থেকে। চেষ্টা করেছি কিন্তু বন্ধকসহ অনেক শর্ত আরোপ করা হয়। তাই সেই পর্যন্ত আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টায় তাই নিজ উদ্যোমেই চলছি।

নয়লির পণ্য তালিকায় আপাতত আছে দেশিয় কাপড়ের তৈরি বিভিন্ন পোশাক, হতে তৈরি গহনা, ঘর সাজানোর সরঞ্জামাদি, চামড়াজাত পণ্য। গুণগত মন বজায় রাখার কারণে এবং যেহেতু আমাদের প্রতিটি পণ্য বাজারের পণ্য থেকে ভিন্ন এবং তাতে শৈল্পিকতা এবং নতুনত্ব আছে, তাই ক্রেতাগণের কাছে এর একটা চাহিদা আছে। আমার সব থেকে বড় অর্জন হলো, আমি এমন কিছু ক্রেতা তৈরি করতে পেরেছি যারা কিনা পূর্বে মনে করত খাদিতে আধুনিকতা নেই, আর আজ তারা রীতিমত খাদি ভক্ত।

অযথা তর্ক পছন্দ নয়, তাই সমালোচকদের মৌখিক জবাব দিতে যাই না। চলার পথে শুভাকাঙ্খিদের দোয়া আর ভালোবাসাটাকে পুঁজি করেছি। আগামীতেও সবার সহযোগিতা চাই। দেশকে বিশ্বের দরবারে নতুন রূপে তুলে ধরার এই প্রচষ্টায় হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাব সবাই মিলে। আমরা বাঙালি, আমরা চাইলেই পারি।

হালাল কাজে লজ্জা কিসের

আজমি রায়হান (উদ্যোক্তা- এ আর ক্যাটারিং)

জীবনানন্দ দাশের কবিতার চরিত্র বনলতা সেন এর শহর নাটোরে নানার বাড়িতে ১৯৯২ সালে জানুয়ারির ১৪ তারিখে ফারজানা খান আজমির জন্ম।

বাবার বাড়ি বা বেড়ে ওঠা আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠেছেন তিনি। দুই ভাইবোন এর মধ্যে আজমি পরিবারের বড় মেয়ে। ভাই জাবি আল নূর খান ছোট। বাবা মো. আবু শের শাহ্ আলম খান উনিও চাকরি জীবন শেষে বিজনেস করেছেন। মা নাজমা খানও একজন উদ্যোক্তা। নারীদের নিয়ে কাজ করেন। হাতের কাজ, সেলাই মেশিনের কাজের প্রশিক্ষণ দিতেন। তার নিজের মহিলা টেইলর আছে যেখানে মহিলারা কাজ করে।

আজমি নবাবগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন ২০০৬ সালে। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ঢাকা থেকে এইচএসসি পাস করেছেন ২০০৯ সালে। এক দুর্ঘটনাজনিত কারণে একটা বছর হারিয়ে যায়। তারপর ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় University of Information Technology & Science's থেকে বিবিএ শেষ করেছেন ২০১৩ সালে। এরপর থেকে শুরু হলো কর্পোরেট জীবন। ব্র্যাক ব্যাংক (২০১৪-২০১৬) সহ লংকা বাংলা (২০১৬-২০১৭)। খান ব্রাদাসর্ (২০১৯-২০২০) এ চাকরি করেছেন তিনি। করোনার ভয়াবহতায় এই চাকরি ছাড়তে হয়েছিল তাকে।

এর মধ্যে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন ২০১৪ সালে। স্বামী রায়হান কাওসার বাপ্পি বিজনেস করেন ঢাকায়। শ্বশুরবাড়ি কিশোরগঞ্জ সদরেই। ২০১৬ সালের নভেম্বরে তাদের সুখের সংসারে তার কোল জুড়ে আসে রাজকন্যা নাবা-ই-নূর আফশিন। তারপর মেয়ে একটু বড় হলে আবার চাকরিতে জয়েন করেন। কিন্তু কভিড-১৯ এ আমার অফিস বন্ধ হয়ে যায়। তিনটা মাস ঘর বন্দি। তখন ফেসবুকে সময়টা বেশি দেয়া হতো। আর সেই ফেসবুক ই হলো আজমির আজকের পথচলা। আর এই পথচলাতে তার মা,বাপ,ভাই সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট করেছেন। ফেসবুকে সময় দিতে গিয়ে যা উনি দেখে উৎসাহ পেয়ে ছিলেন তা হলো বিভিন্ন আপুদের হোম মেড রান্না আর তা অনলাইন এ অর্ডার নিয়ে ডেলিভারি দেয়া।

উনিও ভাবলেন যে এই কাজ তিনিও করতে পারেন। বংশপরম্পরাতে মাশাআল্লাহ ভালোই রান্না করতেন এবং সকলের কাছে প্রশংসাও পেতেন তাই সেই মনোবল নিয়ে শুরু করলেন অনলাইন বিজনেস।তবে এর মাঝে ২০১৯ সালে তরুণ উদ্যোক্তা মেলাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্টল দিয়েছিলেন সকল প্রকার হোম মেড খাবারের। আজমির পেজের নাম AR Catrina, যার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ডিসেম্বর এর ১৪ তারিখ এর ২০১৯ সালে। আলহামদুলিল্লাহ মেলাতেও ভালোই প্রশংসা পেয়েছিলেন সাথে অর্জন ছিল মেলা থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট।

করোনাকালীন সময়ে এই ভালোলাগার রান্নাটাই কাজে দিয়েছিল। প্রথম অর্ডার পান ফ্রোজেন রুটি আর সেই থেকে শুরু হলো ফ্রোজেন আইটেম নিয়ে কাজ করা। এখন লাঞ্চ বক্সসহ সব খাবার সাপ্লাই দিচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ।

তবে জীবনে কখন কি পরিস্থিতিতে পরতে হয় আমাদের জানা নাই। ৪/১১/২০২১ এই দিনে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো মেয়ে কন্যার জন্ম দেই। সিজার করা হয়েছিল কিন্তু এর তিনদিন পর আজমি জানতে পারেন তার গর্ভের মেয়েটা ডেলিভারির তিনদিন আগেই পেটে মারা যায়। তার জীবননাশের আশঙ্কা ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে সব কষ্ট, বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়ান আজমি। থেমে যাননি জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতেও।

তার বিজনেসের স্লোগান - ‘হালাল কাজে লজ্জা কিসের হোক তা ছোট বেকারত্ব কাটিয়ে উঠতে নিজে পরিশ্রম করো’।

পৈতৃকশিক্ষা কাজে লাগিয়েছি

সাহানা (স্বত্বাধিকারী - আম্মা কিচেন)

সাহানা, জন্ম হয়েছে পৈতৃক নিবাস পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকায় ১৯৭৪ সালে। পিতা আকবর আলী এবং মাতা নাসিমা বেগম। ছোট থেকে বড় হয়েছি পুরান ঢাকাতেই। তেমন জাকজমক বা চাকচিক্যে লালিত না হলেও বাবা- মার প্রথম সন্তান হওয়ায় বেশ আদরেই বেড়ে ওঠেছি। পুরান ঢাকার লোকজন খাওয়া দাওয়ায় বেশ সৌখিন হওয়ায় আমার বাবাও পিছিয়ে ছিলেন না। আমার মা ভালো দেশিয় রান্না করতে পারেন। মূলত রান্নার সকল কিছু আমার আব্বার কাছ থেকেই শিখেছি। অনেক রকমের রান্নার আয়োজন চলত আমাদের বাসায়। আমার বাবা, চাচা এবং ভাইরা হোটেল বিজনেস পেশায় জড়িত ছিলেন। বর্তমানে আমার ছোট ভাই তাইওয়ানে বসবাসরত এবং সেখানে ২টি রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করছেন। ২ বোন ২ ভাই এর সংসারে আমি সবার বড়।

টিকাটুলিতে অবস্থিত শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালে এসএসসি করি। এরপর গোপীবাগ লেনস্থিত সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে ১৯৯২ সালে এইচএসসি এবং ১৯৯৪ সালে ঐ একই কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করি।

পড়াশোনার অগাধ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর বেশি দূর পড়া হয়নি। ১৯৯৫ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পর সংসার জীবনে এক সম্ভাবনাময়ী নারী হয়েও কখনো চাকরি বা বিজনেস করার কথা ভাবতে পারেনি।

বর্তমানে আমি তিন সন্তানের জননী। সংসার জীবনে তেমন সুখী ছিলাম না। পড়াশোনা জানা সত্ত্বেও স্বামীর নানান ধরনের নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালে দীর্ঘ ২২ বছরের সংসারের অবসান ঘটিয়ে ৩ সন্তানকে বুকে নিয়ে সন্তানদের শেষ সম্বল নিজ বাসায় এসে আশ্রয় নেই। তখন থেকেই সংগ্রামী জীবনের শুরু। যেহেতু আমি ততদিনে চল্লিশোর্ধ্ব তাই কোনো চাকরির সম্ভাবনা ছিল না। তিন সন্তানের সমস্ত দায় দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে নানা হতাশায় জর্জরিত আমি কোনো কুল কিনারা পাই না।

অতঃপর ২০২০ সালে নানান প্রতিকূলতার মাঝে কিছু লেডিস আইটেম নিয়ে ফেসবুকে পেইজ খুলে কাপড় বিক্রির উদ্দেশ্যে উদ্যোক্তা জীবনের সূচনা করি।

বিধিবাম সেখানেও তেমন সারা না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ি। করোনার কবলে যখন সারাবিশ্ব আতঙ্কিত তখন একজন নতুন উদ্যোক্তা হয়ে কতটুকুই বা করতে পারব। অবশেষে পৈতৃকভাবে রপ্ত করা শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আচার ও হোমমেড ফুড নিয়ে আবারও ওঠে দাঁড়াই বেঁচে থাকার তাগিদে। এবার আল্লাহ সহায়। আর পিছিয়ে পড়তে হয়নি। আচারে বেশ ভালো সারা পেলাম। অনেক অর্ডার আসতে থাকে বিভিন্ন মাধ্যম হতে, পাশাপাশি দেশিয় খাবারেও ব্যাপক পরিচিতি পাই।

বাইরে গিয়ে চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব না বাচ্চাদের রেখে। তাছাড়া তিন সন্তানের সকল দায় দায়িত্ব আমার ওপর। সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করতে হয়। রান্না নিয়ে কিছু করা বা হোমমেড ফুড ক্যাটারিং বিজনেসকে অনেক দূর নিয়ে যেতে চাই। কারণ এ একটা কাজই আছে, যার মাধ্যমে বাসায় থেকে কাজটা করতে পারি। কিন্তু আমি কোনো প্রফেশনাল কোর্স করিনি।

২০২১ সালে Amma kitchen নামে অনলাইন বেজড হোমমেড ফুড ক্যাটারিং এর ব্যবসা শুরু করি। বর্তমানে বেশ ভাল বিজনেস হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্লাস পার্টিতে, জন্মদিনের পার্টিতে, গেটটুগেদার পার্টিতে ইভেন্টগুলোতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। Amma kitchen থেকে ফুড পান্ডায়, হাংরি নাকি, ফুড বাহক এবং পেইজ থেকেও নিয়মিত পরিবেশন হওয়া খাবারগুলোর মধ্যে মোরগ পোলাও, চিকেন বিরিয়ানি, বিফ বিরিয়ানি, কাচচি বিরিয়ানি, তেহারি, কাবাব, ফ্রজেন ফুড, চিকেন রোস্ট, চিকেন টিকিয়া, নেহারি, পিঠা, বার্গার, পরোটা, স্পেশাল চা, ঢাকাইয়া বিভিন্ন খাবার, বিভিন্ন সিজনাল আচারসহ আরো বেশ কিছু রুচিশীল খাবার। প্রতিদিন অফিস লাঞ্চ দিচ্ছেন। রমজান মাসেও ইফতার পার্টির অর্ডার সরবরাহের ব্যবস্থা আছে।

ঈদ, পূজা, রমজান উপলক্ষে নানান কাস্টমাইজ খাবারের অর্ডার নিয়ে অনলাইনে বেশ ভাল সেল করেন। তার স্বপ্ন আচার ও হোমমেড খাবারের নিয়ে একটা দোকান দিবেন। তিনি এ স্বপ্নের মাঝে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।

আমাদের দেশিয় পণ্যের কদর কম

নাহিদ আফরোজ তানি (স্বত্বাধিকারী- আরুশাস কোটর)

আমি নাহিদ আফরোজ তানি। কাজ করছি দেশিয় পোশাক এবং শাড়ি নিয়ে। আমার পেজ আরুশাস কোটর। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল আইনজীবী হবার তাই পড়াশুনা করেছি আইন নিয়ে। পড়াশুনায় যথেষ্ট ভালো ছিলাম। আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার পর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করি। যদিও তখন ইচ্ছে ছিল বিসিএস অথবা জুডিশিয়ারিতে যাওয়ার। কিন্তু বিয়ের পর সেটা হয়ে ওঠেনি।

৬ বছর শিক্ষকতায় ছিলাম। ব্যক্তি জীবনে আমি ২ মেয়ের মা। ২০১৭ সালে আমি ২য় বার মা হই, আমার চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়। কারণ মেয়েদের দেখাশোনা করার কেউ নেই, কিন্তু কাজের মানুষ আমি, হয়তো পারিপার্শ্বিক চাপে আমার কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছে তাই কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। অথচ বাইরে গিয়ে কাজ করাও সম্ভব হচ্ছিল না। ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। সাইক্রিয়েটিস্টের শরণাপন্ন হলাম। রেগুলার কাউন্সিলিং নিতে লাগলাম।

এরমধ্যে বিশ্বে করোনার আঘাত এলো। তখনি মাথায় আসলো অনলাইন বিজনেসের আইডিয়া। ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পণ্য নির্বাচন। আমার বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা তাই সেই সুবাদে বাংলাদেশের অনেক এলাকা ঘুরা হয়েছে। তাই ভাবলাম দেশিয় পোশাক নিয়ে কাজ করি। আর যেহেতু এলাকা আমার পরিচিত তাই ব্যবসা শুরু করতে অসুবিধা হয়নি। নিজের জমানো দশ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করলাম আমার পেজ আরুশাস কোটর। ভয়ে ছিলাম পারব কিনা। আলহামদুল্লিলাহ ব্যাপক সাড়া পেলাম। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

২০২০ সালে শুধু টাঙ্গাইল এর তাঁতিদের তৈরি শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন আমি জামদানি নিয়েও কাজ করছি। আমি নিজে তাঁতিদের কাছে গিয়ে পণ্য সংগ্রহ করি যাতে করে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারি। আজ দেড় বছর পর আমার দশ হাজার টাকার মূলধন এর ব্যবসা লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আমার কাছে আমার ব্যবসা শুধু উপার্জনের জায়গা নয় এটা আমার এনটি ডিপ্রেশনের কাজ করেছে।

আমি এখন স্বপ্ন দেখছি বিশ্ব করোনা মুক্ত হলে আমি শো-রুম নিব এবং আরো বড় পরিসরে আমার ব্রান্ডকে নিয়ে যাব। কারণ কাজ করতে গিয়ে দেখেছি আমাদের দেশের কাপড় কোয়ালিটিফুল হওয়া সত্ত্বেও কদর কম শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে। আর এ কারণে তাঁতিরাও তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না। তাই আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কাজ করে যেতে চাই।

শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসা করছি

মৌসুমী আলম (উদ্যোক্তা-নুসাইবা)

আমি মৌসুমী আলম। ২০১০ সাল থেকে বুটিকস ও খাবার নিয়ে ব্যবসা করছি। পরিবারে দুই বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়।

পড়াশোনায় সব সময় মনোযোগী ছিলাম। জীবনে প্রথম ধাক্কা খাই ক্লাস ফোর মানে চতুর্থ শ্রেণিতে। অংকে দুর্বল থাকায় রেজাল্ট মনঃপুত হয়েছিল না। আব্বা বলে দিল- ‘অনেক হয়েছে, আর লেখাপড়ার দরকার নাই। বাসায় বসে সেলাই করো, রান্না শিখো আর হিসাব করা শিখো।’ আব্বার তিনটা কথাই রেখেছি; পাশাপাশি বাসায় বসে থাকা হয়নি। আব্বাই স্কুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে আলহামদুলিল্লাহ, হিসাবেও আর আটকায়নি।

পড়াশোনা শুরু হয় রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সরকারি সাবিত্রী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করি। কারণ আব্বা-মা প্রথম শ্রেণির সব পড়াশোনা বাসায় শেষ করিয়ে ছিলেন। ভর্তি পরীক্ষায় টপ করেছিলাম। তারপর পর্যায়ক্রমে একই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হয়ে স্কুলজীবন শেষ করি।

এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সরকারি সিটি কলেজ, রাজশাহী থেকে সম্পন্ন করি। তারপর রাজশাহী কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করি। শখ করে ল’ কলেজে ভর্তি হই। কারণ ক্লাসগুলো সব বিকেলবেলায় ছিল। পদ্মার পাড়ে কলেজ ছিল। পড়াশোনা ও প্রকৃতি আমার পক্ষে ছিল সব সময়। তারপর এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে বিএড সম্পন্ন করি এবং ঢাকা আহছানিয়া মিশন থেকে এমএড করি।

লেখাপড়ার পাশাপাশি (এইচএসসি) Summit school (An English medium school) এ কম্পিউটার টিচার হয়ে জীবনের প্রথম চাকরিজীবন শুরু করি। একটানা ১৩ বছর কাজ করে যাই নিশ্চিন্তে। তারপর ২০০৭ সালে ঢাকায় আসি। লাইসিয়াম কিন্ডারগার্টেনে ইংরেজি শিক্ষক হয়ে কাজ শুরু করি। ২০০৮ সালের ১ জুন ঢাকা আহছানিয়া মিশনে জয়েন হই। ইংরেজি শিক্ষক এবং সপ্তম শ্রেণির দায়িত্ব নিয়ে তৃতীয় চাকরি শুরু করি। এখনো দায়িত্বসহকারে কাজ করে যাচ্ছি। অনেকটা শখ করেই ব্যবসা শুরু করি। আমার দুই সন্তান। প্রথম সন্তান নুসাইবা আলম লুবান ও দ্বিতীয় সন্তান সাদাব সাফওয়ান মন্জুর। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করি।

ছোটবেলায় হাতের কাজ শিখেছিলাম বিভিন্ন ক্যাটাগরির। তবে কুশির কাজটা খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছিলাম। তাই ভালোলাগার কাজটা নিজের, মেয়ের ও ছেলের কাপড়ে করতাম। সবাই পছন্দ করত আর আমাকে করে দিতে বলত। ঠিক একই রকম মেয়ের স্কুলের টিচাররাও কাজ দিতে লাগল আর আমি করে দিতে লাগলাম। প্রথম পারিশ্রমিক ছিল ১২০ টাকা। তখন মাথায় এলো যেহেতু সবাই পছন্দ করছে, তা হলে শুরু করি। যেই ভাবা, সেই কাজÑ শুরু করলাম আমার বিজনেস। অনলাইনে ও অফলাইনে। আমার প্রথম পণ্য কুশির কাজ। আর যেহেতু আমি রাজশাহীর মেয়ে, তাই রাজশাহীর ঐতিহ্য রাজশাহী সিল্ককে আমার দ্বিতীয় পণ্য হিসেবে বেছে নিই। ফেসবুকে পেজ ওপেন করি আর সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।

পাশাপাশি ছোটবেলা থেকে রান্নার প্রতিও দুর্বলতা ছিল। খুব মনোযোগ দিয়ে রান্না করতাম। পর্যায়ক্রমে রান্নার কোর্স করি। রান্নার পেজও ওপেন করি আর আমার বিজনেসে অন্তর্ভুক্ত করি। শিক্ষকতার পাশাপাশি দুটো পেজেই কাজ করে যাচ্ছি।

ছোটবেলায় শেখা নিজের কাজটা সবাই যখন পছন্দ করে। আরো ভালো করার সাহস দেয়। সেখান থেকেই কাজের আইডিয়াগুলো পাই। পছন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসা, চাহিদা, কিছু চাওয়া-পাওয়া, কিছুটা আকাক্সক্ষা নিয়েই ব্যবসা শুরু করি। আমি কাজ করছি কুশিপণ্য, রাজশাহী সিল্ক ও ফুড নিয়ে। শুরুটা ছিল অফলাইনে পরিচিতদের চাওয়া থেকে। প্রথমে বিজনেস শুরু করে প্রচুর সমস্যা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে নিজের কাজে বিশ্বাসী ও নিজেকে সৎ প্রমাণ করে কাজ করি। এতে পরিবার ও পরিজন বিপক্ষে থাকলেও তা পরে সহযোগী হয়ে ওঠে।

নতুনদের জন্য বলব- যদি বিজনেস করতে চান, তা হলে নিজেকে আগে প্রশ্ন করুনÑ আপনি বিজনেস করবেন কিনা। শখ করে বিজনেস শুরু করলেন- দু দিন পর বাদ দিলেন; সেটা না করাই উচিত বলে আমি মনে করি। এতে পণ্যকে অপমান করা বোঝায়। আপনি বিজনেস করলে বিজনেসের উপযুক্ত মানসিকতা তৈরি করুন। কি পণ্য নিয়ে কাজ করতে পারবেন তা ঠিক করুন। পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিজেকে সময় দিন ও সততা বজায় রাখুন।

আমার পরিচিত বোন, ভাবীরা আর সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন আমার স্বামী। উনি সহযোগিতা না করলে সংসার, সন্তান, চাকরি নিয়ে বিজনেস করা আমার জন্য অসম্ভব হতো হয়তো। অফলাইন ও অনলাইনে খুবই ভালো রিভিউ পেতাম। তাই বিজনেস শুরু করার সাহস হয়েছিল।

এভাবে সবার ভালোবাসা নিয়ে কাজ করে যেতে চাই। একটা শোরুমের স্বপ্ন দেখি। সেটা বাস্তবে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা সব সময় মনে পুষে কাজ করে যাচ্ছি।

মন্তব্য

Beta version