রোজা এবার পুরোপুরি গরমের মৌসুমে। ফলে সারাদিনের রোজায় ক্লান্ত হয়ে পড়বেন প্রায় সবাই। প্রচণ্ড এ গরমে রোজা রাখার পর সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে ইফতারে চাই এমন কিছু, যা তেষ্টা মেটাবে এবং দূর করবে ক্লান্তি। রমজানে ইফতারের জন্য একটি অতিপরিচিত খাবার হচ্ছে শরবত। বাংলাদেশে এটির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে।
এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত সারাদিনের ক্লান্তি মুছে শরীরকে চাঙা করতেই শুধু ভূমিকা রাখে না, একই সঙ্গে অবসাদ ঘুচিয়ে দিতেও বেশ কার্যকর। তাই ইফতারে সবার চাই স্বাস্থ্যকর এক গ্লাস শরবত। তবে গরম যতই হোক না কেন, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি বা শরবত খেতে কিছুটা সতর্ক থাকা জরুরি। কেননা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীরে তাপ অনেক বেড়ে গেলে সেই সময় ফ্রিজের খুব ঠান্ডা পানি খাওয়ার বদলে নরমাল ঠান্ডা পানি বা শরবত খাওয়া উচিত। অধিক ঠান্ডা পানি শরীরের ক্ষতি হতে পারে।
রৌদ্রতপ্ত দিনের পানির চাহিদা মিটানোর জন্য প্রয়োজন অনেক বেশি পানি পান করা। কিন্তু অনেকেরই পানি বেশি খাওয়ার অভ্যাস নেই। আবার বারবার পানি খেতে একঘেয়েমি লেগে যায়। এ ক্ষেত্রে পুষ্টিগুণের পাশাপাশি শরীরের পানির স্বল্পতা দূর করতে শরবতের জুড়ি মেলা ভার।
বাজার এখন মৌসুমি ফলে ভরপুর। এসব ফল দিয়েই বানিয়ে ফেলতে পারেন ঠান্ডা মজাদার শরবত। বাজার থেকে এনে পরিষ্কার ও জীবাণুুমুক্ত করে ফেলুন আপনার পছন্দের ফল এবং রমজানের পুরো মাসজুড়ে সতেজ থাকতে একেক দিন বেছে নিতে পারেন পছন্দের একেকটি শরবত। কোনো স্বাস্থ্যঝুঁঁকি ছাড়াই এসব শরবত আপনার ও আপনার পরিবারকে করবে প্রাণবন্ত। সেই সঙ্গে তাজা ফলের তৈরি শরবতের পুষ্টিগুণ আপনাকে করবে সতেজ ও সুন্দর।
তাই চলুন চটপট কিছু সহজ, সুস্বাদু শরবত তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ, প্রস্তুত প্রণালি ও উপকারিতা দেখে নেওয়া যাক।
১. পুদিনার শরবত
উপকরণ : পুদিনা পাতা বাটা ২ চা চামচ, লেবুর রস ২ টেবিল চামচ, চিনি ২ টেবিল চামচ, ১ চিমটি বিট লবণ, স্বাদমতো লবণ এবং পানি ১ গ্লাস।
প্রস্তুত প্রণালি : প্রথমে পুদিনা পাতা ধুয়ে ব্লেন্ড করে নিন। এবার পানির সঙ্গে পুদিনা পাতা বাটা, চিনি ভালো করে মিশিয়ে ছেঁকে নিন। চিনিতে সমস্যা হলে এর পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করতে পারেন বা চিনি বাদ দিয়ে লবণ ও ১ চিমটি বিট লবণ মিশিয়ে নিন। সবার শেষে লেবুর রস দিয়ে দিন।
উপকারিতা : এ শরবত পানে অনেক বেশি সতেজ অনুভূত হয়। পুদিনা পাতা ও লেবুর রসের মিশ্রণ শরীরের পুষ্টির চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে পেটের যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে খুব দ্রুত।
২. দুধ তোকমার শরবত
উপকরণ : তোকমার দানা ১ টেবিল চামচ, চিনি ১ টেবিল চামচ, বরফকুচি ২ টেবিল চামচ এবং রুহ-আফজা ১/২ চা চামচ।
প্রস্তুত প্রণালি : প্রথমে দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে নিন। শরবত বানানোর আধাঘণ্টা আগে তোকমার দানা ১/২ গ্লাস খাবার পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। ভিজিয়ে রাখা তোকমার দানা ঠান্ডা দুধে মিশিয়ে নিন। চিনি ও রুহ-আফজা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন। বরফকুচি মিশিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিন। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করুন।
উপকারিতা : এ গরমে দেহের তাপ কমাতে এ শরবত বিশেষ সহায়ক। শুধু ইফতার নয়, সেহেরিতেও খেতে পারেন। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর আঁশ, যা বাড়তি ক্ষুধা দূর করে এবং পেট দীর্ঘক্ষণ পরিপূর্ণ থাকার অনুভূতি দেয়। দেহের ওজন কমাতে এ বীজের জুড়ি নেই। তোকমার ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ ছাড়া এর নানা উপাদান দেহের চর্বি কমাতে সহায়তা করে। তাই এ রমজানে প্রতিদিনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হতে পারে এ শরবতটি।
৩. আদা লেবুর শরবত
উপকরণ : আদার রস ১ চা চামচ, লেবুর রস ১ টেবিল চামচ, চিনি ২ টেবিল চামচ, ঠান্ডা পানি ১ গ্লাস।
প্রস্তুত প্রণালি : সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে শরবত বানাতে হবে। ইফতারের সময় এই শরবত খুবই ভালো লাগবে।
উপকারিতা : দীর্ঘসময় রোজা রাখার ফলে হাতে-পায়ের বা শরীরের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে এ শরবত। এ ছাড়া ক্যানসার, বমি বমি ভাব, রক্তচাপ কমাতেও বিশেষ উপকারী আদা লেবুর শরবত। ইফতারে ভাজাপোড়া খাবার বেশি খাওয়া হয়। তাই লেবুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চর্বি কমাতে সাহায্য করবে আশা করা যায়।
৪. শসার শরবত
উপকরণ : শসা ২৫০ গ্রাম, ধনে পাতা কুচি আধা টেবিল চামচ, বিট লবণ সামান্য, চিনি সামান্য, কাঁচামরিচ ১টি এবং পানি সামান্য।
প্রস্তুত প্রণালি : শসার খোসা ছাড়িয়ে এবং বীজ ফেলে কুচি করে নিন। এরপর সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে ব্লেন্ড করে নিতে হবে। এবার সুদৃশ্য একটা শরবতের গ্লাসে বরফকুচি দিয়ে পরিবেশন করুন মজাদার শসার শরবত।উপকারিতা : স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের বিশেষ পছন্দের এ শরবত শুধু আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো তাই নয়, এটি দেহের ক্যানসার প্রতিরোধ করার শক্তি বৃদ্ধি করে। ইফতারে এ শরবত দেহের পানিশূন্যতা দূর করার পাশাপাশি দেহের বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে। যাদের হজমের সমস্যা আছে, তারা অবশ্যই এ শরবত পান করে দেখতে পারেন। আশা রাখি উপকার পাবেন।
৫. আমের শরবত
উপকরণ : কাঁচা আম কুচি এককাপ, চিনি স্বাদমতো, পানি আধাকাপ, বিট লবণ এক চিমটি, পরিমাণমতো বরফ কুচি।
প্রস্তুত প্রণালি : আম ভালোভাবে ধুয়ে কেটে টুকরো করে নিন। এবার ব্লেন্ডারে একে একে আম, পরিমাণমতো বিট লবণ, কাঁচামরিচ, চিনি ও পানি দিন। সবকিছু একসঙ্গে ভালো করে ব্লেন্ড করুন ২ মিনিট। হয়ে গেল দারুণ স্বাদের কাঁচা আমের শরবত। গ্লাসে ঢেলে বরফ টুকরো দিয়ে পরিবেশন করুন।
উপকারিতা : গরমের প্রধান প্রশান্তি বলা চলে আমকে। প্রচণ্ড সুস্বাদু আমের শরবত ইফতারে পান করলে এক নিমিষে জুড়িয়ে যাবে আপনার মন-প্রাণ। ফাইবার সমৃদ্ধ এ ফল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বিশেষ সহায়ক। ভিটামিন-সি যুক্ত হওয়ায় ঠান্ডাজনিত রোগ নিরাময়ে উপকারী। অ্যাসিডিটি নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী এ শরবত পানে শরীর নানাবিধ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে আশা করা যায়।
৬. তরমুজের শরবত
উপকরণ : তরমুজ কুচি দুই কাপ, চিনি ২ টেবিল চামচ, বিট লবণ আধা চা চামচ, লেবুর রস ২ চা চামচ, বরফ কুচি।
প্রস্তুত প্রণালি : তরমুজ কুচিসহ সব উপকরণ মিশিয়ে ব্লেন্ড করে ফ্রিজে রেখে দিন। প্রয়োজনীয় ঠান্ডা হলে নামিয়ে এনে পরিবেশন করুন রঙিন এক গ্লাস ঠান্ডা তরমুজ শরবত।
উপকারিতা : দেখতে সুন্দর, স্বাদে ভরপুর এ শরবত ইফতারে আপনাকে দেবে বিশেষ প্রশান্তি। গরমে প্রাণ জুড়াতে তরমুজের শরবতের জুড়ি নেই। সুস্বাদু এ শরবত কিডনি সুস্থ রাখার পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। তরমুজের শরবত অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া প্রোস্টেট ক্যানসার, কোলন ক্যানসার ও ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
৭. আনারসের শরবত
উপকরণ : আনারস কুচি ১ কাপ, বিট লবণ আধা চা চামচ, চিনি ২ চা চামচ, গোলমরিচের গুঁড়া ২ চা চামচ, পানি পরিমাণমতো।
প্রস্তুত প্রণালি : আনারস কুচির সঙ্গে বিট লবণ, চিনি, গোলমরিচের গুঁড়া ও পানি একসঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে ব্লেন্ড করে নিন। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল আনারসের শরবত। এবার সুন্দর একটি গ্লাসে ঢেলে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।
উপকারিতা : আনারসের শরবত খুব পুষ্টিকর একটি পানীয়। অত্যধিক পরিমাণে ভিটামিন সি ও ফাইবার থাকায় এটি ত্বকের জন্য খুব উপকারী। ইফতারিতে অনায়াসে খেতে পারেন এ শরবত। কারণ খালি পেটে এ শরবত কৃমি নিবারণে সাহায্যকারী। আনারসে আছে উচ্চমাত্রায় পানিতে দ্রবণীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন-সি এবং পানিতে দ্রবণীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহকে ফ্রি-রেডিকেল থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। ফলে ক্যানসার এবং হৃদরোগের মতো মারাত্মক রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে না।
৮. জামের শরবত
উপকরণ : জাম ১ কাপ, পানি ১ কাপ, চিনি ১ টেবিল চামচ, লেবুর রস ১ চা চামচ, অর্ধেক কাঁচামরিচ, পুদিনা পাতা কুচি, পরিমাণমতো লবণ।
প্রস্তুত প্রণালি : জাম বিচি থেকে আলাদা করুন। এবার অন্যান্য সব উপকরণ আর জাম একসঙ্গে ব্লেন্ড করে নিন। চাইলে ছেঁকে নিন অথবা না ছেঁকে নিলেও হবে। ফ্রিজে রেখে দিন ঠান্ডা হওয়ার জন্য। ঠান্ডা হলে ইফতারে পরিবেশন করুন।উপকারিতা : সারাদিনের কর্মব্যস্ত শরীরকে নিমিষেই তরতাজা করতে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে জামের শরবত। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী এ শরবত ইফতারে শুধু তৃষ্ণা মেটাবে না, মেটাবে প্রয়োজনীয় নানান পুষ্টির চাহিদা।
৯. তেঁতুলের শরবত
উপকরণ : তেঁতুল, বিট লবণ, চিনি, কাঁচামরিচ কুচি, ধনিয়া পাতা কুচি, শুকনা মরিচের গুঁড়া, ঠান্ডা পানি।
প্রস্তুত প্রণালি : প্রথমে তেঁতুল থেকে বিচি আলাদা করে একটি পাত্রে তেঁতুল গুলে নিন। গোলানো তেঁতুলের সঙ্গে পরিমাণমতো ঠান্ডা পানি মিশান। এবার তেঁতুলের সঙ্গে একে একে পরিমাণমতো চিনি, বিট লবণ, টেলে রাখা শুকনা মরিচের গুঁড়া, কাঁচামরিচ কুচি ও ধনিয়া পাতা কুচি দিন এবং নেড়ে ১০ মিনিট রাখুন। তেঁতুলের মিশ্রণটি অন্য একটি পাত্রে ছাকনি দিয়ে ছেঁকে নিন। গ্লাসে ঢেলে বরফ কুচি দিয়ে পরিবেশন করুন।
উপকারিতা : গরমে তেঁতুলের শরবত দেবে অতুলনীয় প্রশান্তি। তেঁতুল রক্তের কোলস্টেরল কমায়। তাই এ রমজানে পেটে গ্যাস হলে তেঁতুলের শরবত অনেকটা সাহায্য করবে। তেঁতুলে থাকা ভিটামিন-মিনারেলস স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপকারী।
১০. পুদিনা পেস্তার লাচ্ছি
উপকরণ : মিষ্টি দই ১ কাপ, পুদিনা ২ টে. চামচ, পেস্তা বাদাম ১ টে. চামচ, কাঁচামরিচ ১টা, চিনি ২ টে. চামচ এবং বরফ ১০-১২ টুকরো।
প্রস্তুত প্রণালি : প্রথমে মিষ্টি দই, পুদিনা, পেস্তা বাদাম, চিনি, কাঁচামরিচ ও বরফের টুকরোগুলো ব্লেন্ডারে নিয়ে খুব ভালো করে ব্লেন্ড করে নিয়ে, পছন্দেও গ্লাসে ঢেলে ওপরে পুদিনা ছিটিয়ে পরিবেশন করুন।
উপকারিতা : অনেক সুস্বাদু এ শরবত এ গরমে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করবে। পুদিনা পাতায় থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট পেটের যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে। শরবত ছাড়া ইফতারে তৃষ্ণা মেটানো দায়। পানির চাহিদা পূরণে সহায়ক। ফলের শরবতের উপকারী খাদ্য গুণাবলি শরীরের ক্ষয়পূরণেও বিশেষ উপকারী। নিজেকে সুস্থ রাখি এবং আশপাশের নিম্নআয়ের মানুষকে যথাসাধ্য সাহায্য করি।
মন্তব্য