বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কেরও ক্ষয় হয়। তবে ক্ষয়ের মাত্রা কমানোর জন্য রয়েছে নানা পন্থা। নিয়মিত শরীরচর্চা, নতুন কিছু শেখার চেষ্টা, ঘুমকে প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি সার্বিক স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো মস্তিষ্ক সুস্থ রাখতে কার্যকর। তবে মস্তিষ্ক প্রখর রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পুষ্টি উপাদান।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘লেনক্স হিল’ হাসপাতালের সনদস্বীকৃত পুষ্টিবিদ জনাথান পার্টেল রিয়েলসিম্পল ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, মস্তিষ্ক বিরামহীনভাবে কাজ করে যায় প্রতিটি মুহূর্ত। স্মৃতিশক্তি ও জ্ঞানীয় ক্ষমতা তো আছেই, শ^াস-প্রশ^াস, নড়াচড়া, তাপমাত্রা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক কার্যক্রমগুলোর নিয়ন্ত্রণ মস্তিষ্কের হাতে।
মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাদ্যাভ্যাসে কী থাকবে এই বিষয়ে ‘কেইস ইন্টিগ্রেটিভ হেলথের প্রতিষ্ঠাতা ও ‘মেডিকেল ডিরেক্টর’ কেসি কেলি একই প্রতিবেদনে বলেন, তাজা, পরিপূর্ণ খাবারই হলো মস্তিষ্কের আদর্শ খোরাক। ফল, সবজি, পরিপূর্ণ শষ্য আর ‘লিন প্রোটিন’ সবই এর অন্তর্ভুক্ত। এই খাবারগুলো থেকে পাওয়া যে পুষ্টি উপাদানগুলো মস্তিষ্কের কাজে লাগে তা হলোÑ ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডস, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, সি, কে।
শুধু খাওয়া নয়, মস্তিষ্ক ভালো রাখার জন্য কিছু খাবার বাদ দেওয়াও জরুরি। প্রক্রিয়াজাত খাবার, ‘স্যাচুরেইটেড ফ্যাট’, ‘ট্রান্স ফ্যাট’, খাবারে যোগ করা বাড়তি চিনি ও লবণ বাদ দিলে মস্তিষ্ক আপনাকে ধন্যবাদ দেবে। এসবের মাঝে কিছু খাবারের কথা বিশেষভাবে বলতেই হয়। সেগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পত্রল সবুজ সবজি
ডা. কেলি বলেন, কেইল, পালংশাক, ব্রকলি এই সবজিগুলো মস্তিষ্ক ভালো রাখার জন্য আদর্শ খাবার। কারণ মস্তিষ্কের যে পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন সেগুলোতেই ভরপুর এগুলো। ভিটামিন এ মস্তিষ্কের ‘নিউরনের স্মৃতিশক্তি সংরক্ষণ ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতাকে সুরক্ষিত রাখে। ভিটামিন সি জোগায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আর ভিটামিন কে’তে আছে প্রদাহনাশক গুণাগুণ। ‘অক্সিডেটিভ স্ট্রেস’ থেকে সুরক্ষা দেয় এই ভিটামিনগুলো।
তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন দুই থেকে তিন কাপ গাঢ় সবুজ রঙের সবজি খাওয়া অভ্যাস করতে হবে। শুধু সালাদ বানিয়েই খেতে হবে তা নয়। ডিম ভাজাতে এক কাপ পালংশাক কুচি মিশিয়ে দিতে পারেন। ‘ব্লেন্ডার’ বানিয়ে নিতে পারেন কেইলের স্মুদি। সুপের সঙ্গে মিশিয়েও সবজি খাওয়া যায়।
বেরি ঘরানার ফল
ডা. কেলি বলেন, এই ফলগুলোতে মেলে ‘ফ্লাভানয়েডস’, যা এক ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এই উপাদানের কারণেই জাম বা বেরি ঘরানার ফলের রং উজ্জ্বল হয়। তবে ‘ফ্লাভানয়েডসে’র কাজ ফলের সৌন্দর্য বাড়ানোতে সীমাবদ্ধ নয়, স্মৃতিশক্তিও অক্ষুণ্ন রাখে উপাদানটি।
বিভিন্ন ‘নিউরন’ বা স্নায়ুকোষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষায় ভূমিকা আছে ‘ফ্লাভানয়েডসে’র। ফলে ভালো থাকে জ্ঞানীয় ক্ষমতাও। আর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হওয়ায় ‘অক্সিডেটিভ স্ট্রেস’ থেকে সুরক্ষা তো দেয়ই। পরামর্শ দিতে গিয়ে ডা. কেলি বলেন, সপ্তাহের তিন দিন ন্যূনতম আধা কাপ জাম ঘরানার যেকোনো ফল খাওয়া চেষ্টা করুন। জাম, ব্লু বেরি, স্ট্রবেরি ইত্যাদি এই ধরনের ফলের অন্তর্ভুক্ত।
কাঁচা, সালাদে বা অন্য খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে যেকোনো ভাবেই খেতে পারেন।
বাদাম
পার্টেল বলেন, বাদামে মিলবে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডস যা মস্তিষ্কের গঠনকে মজবুত রাখে। রক্তপ্রবাহ সচল রাখতে এই পুষ্টি উপাদান জরুরি যা পক্ষান্তরে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে। এছাড়া বাদামে পাওয়া যায় ভিটামিন ই, দস্তা ও সেলেনিয়াম। যার সবই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গুণাগুণ সমৃদ্ধ।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলে, সপ্তাহের চার দিন কমপক্ষে দেড় আউন্স বাদাম বিনা লবণে খাওয়া উচিত সবার। হাতের মাপে তা প্রায় একমুঠ। যেকোনো ধরনের বাদাম যে কোনোভাবেই খাওয়া যায়।
চর্বিওয়ালা মাছ
ডা. কেলি বলেন, চর্বিযুক্ত মাছ থেকে আসে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডস। অন্যান্য উপকারিতার পাশাপাশি এই উপাদান রক্তে ‘বেটা-অ্যামিলয়েড’ নামক প্রোটিনের মাত্রা কমায়। বিশেষ এই প্রোটিন হলো ‘আলঝাইমার’স ডিজিজ’ ও ‘পারকিনসনস ডিজিজে’র ঝুঁকিবর্ধক। আর মস্তিষ্কের এই রোগগুলো ঝুঁকি কমিয়ে আনবে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডস। সপ্তাহে অন্তত দুদিন চর্বিওয়ালা মাছ খাওয়া উচিত।
একবেলায় খাওয়া যাবে তিন আউন্স বা এক কাপের চার ভাগের তিন ভাগ পরিমাণ, পরামর্শ আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের। স্যামন, তেলাপিয়া, সার্ডিনস, পলক এই মাছগুলো আদর্শ। এর বাইরে হলে এমন মাছ বেছে নিতে হবে যাতে মার্কারি’র মাত্রা কম।
ডার্ক চকলেট
পার্টেল বলেন, চকলেট থেকেও পেতে পারেন ‘ফ্লাভানয়েডস’। মস্তিষ্কের কী উপকার করে তা আগেই বলা হয়েছে। পাশাপাশি এটি হৃদযন্ত্রের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। ৭০ শতাংশ কোকো আছে এমন ডার্ক চকলেট প্রতিদিন এক আউন্স করে খাওয়া যাবে। কোনো বাড়তি চিনি যোগ করা আছে কি-না তা দেখে নিতে হবে, থাকলে সেটা বাদ দিয়ে অন্য চকলেট নিতে হবে।
কারণ এই বাড়তি চিনি বাড়াবে ‘অক্সিডেটিভ স্ট্রেস’। তবে যে চকলেটে কোকো’য়ের মাত্রা বেশি তাতে চিনি সাধারণত কমই থাকে।
চা
পার্টেল বলেন, সবদেশে জনপ্রিয় এই পানীয়তেও প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট মেলে। গ্রিন, ব্ল্যাক আর লায়ন’স মেন টি’ মস্তিষ্কের জন্য সবচেয়ে উপকারী। চায়ে আরো আছে ‘এল-থিয়ানাইন’, একটি অ্যামিনো অ্যাসিড যা বাড়ায় মনোযোগ ও সতর্কতা। মস্তিষ্কের যে অংশ স্মৃতিশক্তির জন্য দায়ী সেই অংশকে ভালো রাখতে ‘লায়ন’স মেন টি’ বিশেষভাবে কার্যকর।
দিনে দুই তিন কাপ চা পান করাই যথেষ্ট এর পরিপূর্ণ উপকারিতা পাওয়ার জন্য। দিনের শেষভাগে, ঘুমানোর আগে চা পান থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে থাকা ‘ক্যাফেইন’ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
মন্তব্য