-->

আত্মহত্যা কি জীবনের শেষ সমাধান

সুপ্তি রায়
আত্মহত্যা কি জীবনের শেষ সমাধান

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় গত ২০ অক্টোবর মারজান আক্তার (২১) নামের এক গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ তার বাবার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ওই গৃহবধূ ‘আত্মহত্যার’ আগে এক ভিডিও বার্তায় স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও দাদিশাশুড়ির বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেন। গৃহবধূর বাবা আবু নাছের ওই ভিডিওটি পুলিশের কাছে জমা দিয়েছেন।

 

এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনায় থানায় মামলা করা হয়েছে। এভাবে মারজান আক্তারের মতো আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে প্ররোচনাসহ অনেক কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

নেত্রকোনার দুর্গাপুরে স্বামীর পরকীয়ার জেরে স্ত্রী তাসলিমা আক্তার (২৫) নামের এক গৃহবধূর আত্মহত্যার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় স্বামী মো. সুলতান মিয়াসহ ৪ জনকে আসামি করে দুর্গাপুর থানায় একটি মামলা হলে গত ৩ ডিসেম্বর অভিযুক্ত স্বামীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

 

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ৮ বছর আগে পৌর শহরের দশাল ঠাকুরবাড়ি কান্দা এলাকার সুলতান মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় তাসলিমার। তাদের সংসারে ২ সন্তান আছে। সবকিছুই ভালোভাবে চলছিল। কিন্তু ৩ বছর আগে একই এলাকার ঝুমা আক্তার নামের এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন সুলতান। এ ঘটনায় স্ত্রী তাসলিমা স্বামীকে ফেরানোর চেষ্টা করলে তাসলিমাকে মারপিটসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করত সুলতান।

 

ঘটনার দিন গত বুধবার দুপুরে তার স্বামী ও ঝুমা আক্তারকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেন তাসলিমা। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওইদিন তার স্বামী তাকে বেদম মারধর করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাসলিমা নিজ ঘরে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাসলিমা মারা যান বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

 

বিপুল অঙ্কের টাকা দেনার দায়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন রাজধানীর পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের এক ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে রাজধানীর চকবাজার থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

 

পুলিশ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ৩ ডিসেম্বর ভোরে পুরান ঢাকার চকবাজার থানার ৭ নম্বর নূর ফাত্তাহ লেনের বাসায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় রশি পেঁচিয়ে ফাঁস দেন ব্যবসায়ী বাবলু কুমার সাহা (৫৫)।

 

বাবলু কুমার সাহার শ্যালক সঞ্জয় কুমার সাহা বলেন, বাবলু কুমারের ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নূর ফাত্তাহ লেনের একটি বাসায় থাকতেন। ব্যবসায় অনেক টাকার লোকসান হয়েছে। সেজন্য মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের জেলার ভাঙ্গা উপজেলায়।

 

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মো. জাফর হোসেন বলেন, ‘ব্যবসায়ী বাবলু কুমার সাহা অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি একটি চিরকুট লিখে গেছেন। এ বিষয়ে চকবাজার থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

 

এভাবে মারজান আক্তার, তাসলিমা আক্তার ও বাবলু কুমার সাহার মত আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা অগণিত।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যা হলো এমন একটি মানসিক ভারসাম্যহীনতা, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজের স্বত্তাকে ধ্বংস করতে উদ্বুদ্ধ হয়। কোনো সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়।

 

আমরা অনেকেই এবিষয়টি না বুঝেই আত্মহত্যাকারী কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে নিজেদের মনগড়া মন্তব্য ছুঁড়ে দেই। কিন্তু আত্মহত্যা নিয়ে কথা বলার আগে বুঝতে হবে সেই ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। কারণ আত্মহত্যা এমন একটি সাইকোলজিক্যাল (মানসিক) বিষয় যার উপর পুরো পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে চলেছেন।

 

আত্মহননের বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে; তা হলো অভাববোধ। তাদের মতে কারো হতে পারে অর্থের অভাব, কারো বা ঘনিষ্ঠ সহচার্যের অভাব, কারো মেধার অভাব, কারো মেধা থাকা স্বত্তেও চাকুরির অভাব, কারো পারিবারিক শান্তির অভাব, কারো কাছে স্ত্রী/পুত্র/পরিজনের অভাব প্রভৃতি। মূলত কোনো কিছুর অভাববোধ বা না পাওয়ার কষ্ট কাটিয়ে উঠতে না পারলে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। এদের মধ্যে বয়স ৩০ বছরের নিচের নারীদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৩.৯ শতাংশ।

 

অন্যদিকে বেসরকারি সংগঠন ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’র জরিপ অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ৪০৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ২৬৯ জন আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর বয়সসীমা ১৩ থেকে ১৯ বছর এবং নারীর সংখ্যা বেশি (২৪১) জন। অন্যদিকে বিভাগ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে (১২৬জন)।

 

জরিপ আরো বলছে, দেশে কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (১১০জন)। ইউনিভার্সিটির ও মাদরাসার শিক্ষার্থী আছে যথাক্রমে ৭৮ জন ও ৩৪ জন। এছাড়া জরিপে পাওয়া গেছে, অভিমান জনিত কারণে নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

 

জরিপ বলছে, মূলত পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, যৌন হয়রানি, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, হতাশা ও আর্থিক সংকটই ছিল এসব আত্মহত্যার মূল কারণ।

 

ক্রমবর্ধমান এই আত্মহত্যা রোধ করার উপায় সর্ম্পকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন এর সঙ্গে কথা হয়। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আত্মহত্যা রোধ করার উপায় হচ্ছে, সামাজিক সচেতনা তৈরি করতে হবে। আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনে সংবাদ মাধ্যমকে অনেক বেশি সেনসিটিভ হতে হবে এবং অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। পরিবারগুলোর ভিতর পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে হবে। কারো ভিতর মানসিক রোগ এবং মাদকাসক্তি থাকলে তার তৎক্ষণাত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। দেরি করা যাবে না।’

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, জনসংখ্যায় বিস্ফোরিত এই বাংলাদেশে পারিবারিক ব্যবস্থাপনার যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে। পরিবারগুলো সন্তানদের প্রত্যাশিত চাহিদা পূরণ করতে না পারায় তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়।

 

এছাড়া বেকারত্ব, প্রেমে বিচ্ছেদ, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অপব্যবহারকেও তিনি অনেকাংশে দায়ী করেছেন।

 

তিনি আরো বলেন, পারিবারিক মনিটোরিং বাড়াতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে পারিবারিককে সীমাবদ্ধতা জারি করতে হবে (নির্দিষ্ট সময়ের পর নেট ব্যবহার করা যাবে না) তাহলে আত্মহত্যার সংখ্যা কমে যাবে। এছাড়া বেকারত্ব দূরীকরণে বর্তমান সরকারের গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বেকারত্ব দূর হওয়ার পাশাপাশি আত্মহত্যার সংখ্যা কমে যাবে।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমান তরুণ সমাজের মধ্যে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকট দিনদিন বাড়ছে। যার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। করোনার সময় বেড়েছিল একাকিত্ব, গৃহবন্দি জীবন-যাপন, বেকারত্ব এসব কারণে আত্মহত্যা। বর্তমানে নতুন করে দেখা যাচ্ছে জটিল রোগাক্রান্ত রোগীরাও আত্মহত্যা করে থাকে।

 

এজন্য প্রয়োজন সঠিক কারণ চিহ্নিত করে সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। এক্ষেত্রে পারিবারিক মনিটোরিং বাড়ানো, কাউন্সেলিং করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি।

 

মনোবিজ্ঞানের সাবেক শিক্ষার্থী এবং সাহিত্যিক মুস্তাফিজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, একদিনে কেউ কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। এটি দীর্ঘদিনের মানসিক রোগ। আত্মহত্যা করার আগে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায় যেমন, সে একা থাকতে চায়, একাকিত্ব বোধ করে, তাকে দিয়ে জীবনে কিছু হবে না বিশ্বাস করতে শুরু করে (অনেকটা প্ল্যানচ্যাটের মতো), সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরণের পোষ্ট করে থাকে। তাই পরিবারগুলোর উচিত সন্তানদের অভাবকে মেনে নেওয়ার বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া এবং পারিবারিক কাউন্সেলিং হতে পারে এর সমাধানের একমাত্র উপায়।

 

সম্প্রতি অভিনেত্রি হুমায়ারা হিমু আত্মহত্যা করেছেন। যদিও এটি আত্মহত্যা না খুন তদন্তের বিষয়। তিনিও একাকিত্বের কারণে এমনটা করেছেন। তাই সন্তানদের একাকিত্ববোধ করতে দেওয়া যাবে না।

 

অনুপম নামের একজন সিনিয়র মেডিকেল প্রমোশন অফিসার ভোরের আকাশকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবেগে। চাকুরিজীবিরা আত্মহত্যা করে কাজের চাপে, পরিবারের খরচ সমাল না দিতে পেরে। ব্যবসায়ীরা দেওলিয়া হয়ে যাওয়ার পর আত্মহত্যা করে। আর একজন স্ত্রী তখনই আত্মহত্যা করে যখন সে মনে করে পৃথিবীতে তাকে বোঝার মতো কেউ নেই।

 

অন্যদিকে একজন পুরুষ আত্মহত্যা করে যখন সে মনে করে সে সকলের কাছে বোঝাস্বরূপ। এরকম আত্মহত্যা করার হাজারটা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু পরিবারগুলোর ভিতর পারিবারিক বন্ধন যদি বাড়ানো যায় তবে, একজন দেওয়ালে পিঠ ঠেঁকে যাওয়া ব্যক্তিও আত্মহত্যার কথা চিন্তা করতে পারবে না। বরং সমস্যার বিকল্প সমাধান খুঁজে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করবেন। কারণ আত্মহত্যাই জীবনের শেষ সমাধান নয়।’

 

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবি নারী আইনুন নিশাত এ বিষয়ে ভোরের আকাশকে বলেন, নিজেকে ভালোবাসতে হবে, নিজের মনের যত্ন নিতে হবে। তবেই আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যাবে। যারা আত্মহত্যা করে তাদের নিজেদের প্রতি মায়া নেই বলেই এ কাজ করতে পারে। তাই আত্মহত্যার সংখ্যা কমাতে নিজেকে ভালোবাসা জরুরি বলে আমি মনে করি।

 

প্রায় সব ধর্মই আত্মহত্যাকে মহাপাপ ও ক্ষমার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে। তাই একাকীত্ব বা যেকোনো মানসিক সমস্যা থেকে বাঁচতে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া কখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। যে কোনো পরিস্থিতিতেই জীবনকে উপভোগ করা শিখতে হবে। প্রয়োজনে ভ্রমণে বের হোন, নয়তো মন খুলে কথা বলুন বন্ধুদের সাথে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version