-->

বাকরখানি : যার নামকরণের নেপথ্যে করুণ প্রেমকাহিনী

আশীষ কুমার দে
বাকরখানি : যার নামকরণের
নেপথ্যে করুণ প্রেমকাহিনী

রাজধানী ঢাকা বিশেষ করে ঢাকার পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে বারকরখানির সমাদার বহু আগে থেকেই। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ বাকরখানি। বিভিন্ন দোকানের সামনে কাচের বাক্সে রাখা গোল গোল বাকরখানি ছাড়া পুরান ঢাকার মানুষের বিকেলের নাশতা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। দুধ-চায়ে ডুবিয়ে বাকরখানি মুখে দিতেই স্বর্গীয় এক অনুভূতি হয় সেখানকার মানুষের। তবে এই শুকনো খাবারের পরিচিতি ও চাহিদা পুরান ঢাকা ছাপিয়ে এখন সমগ্র ঢাকা, এমনকি সারাদেশে। বাকরখানি তৈরি ও বিক্রির দোকান প্রথম গড়ে উঠেছিল পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার কাছে। যদিও বিশেষ এই খাবার ঠিক কতো সাল থেকে বিক্রি শুরু হয় তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি।

তবে বাকরখানির স্বাদ ও সমাদর নিয়ে যতো আলোচনাই থাকুক না কেনো, এই খাবারের নামকরণের পেছনে রয়েছে এক করুণ প্রেমকাহিনী। বিয়োগান্ত সেই প্রেমকাহিনীর উল্লেখ রয়েছে নাজির হোসেন রচিত ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থে। সুবাদার শাসনের সময় বাংলার মসনদে তখন আসীন ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। তুরস্কের অধিবাসী তরুণ আগা বাকের ভাগ্যের অন্বেষণে আসেন ভারতবর্ষে। নাম লেখান সেনাবাহিনীতে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে মুর্শিদকুলি খাঁর সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হন তিনি। কথিত আছে, সে সময়ের বিখ্যাত গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী খনি বেগমের সঙ্গে মনের আদান-প্রদান হয়েছিল আগা বাকেরের।

কিন্তু একই সময়ে খনি বেগমের ওপর দৃষ্টি পড়ে উজিরে আলা জাহান্দর খাঁর পুত্র জয়নুল খাঁর। এ নিয়ে বাকেরের সঙ্গে লড়াই বেঁধে যায় তার। জয়নুল খাঁ পালিয়ে যান। কিন্তু রটে যায়, আগা বাকের জয়নুলকে হত্যা করে লাশ গুম করেছেন। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ বাকেরকে শাস্তি দেন। তাকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জ্যান্ত বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে আসেন আগা বাকের।

এই লড়ায়ের পূর্ণ সুযোগ নেন জয়নুল খাঁ। লড়াই চলাকালে খনি বেগমকে অপহরণ করে ভাটি বাংলার গহীন অরণ্যে পালিয়ে যান তিনি। অনমনীয় খনি বেগমকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে আটকে রাখেন চন্দ্রদ্বীপে (বর্তমান বরিশাল)। এই সংবাদ পৌঁছে যায় বাকেরের কাছে। সেনাপতি কালা গাজীকে নিয়ে খনি বেগমকে মুক্ত করতে ছুটে যান বাকের। জয়নুল খাঁর বাবাও ছেলেকে শাস্তি দিতে আসেন চন্দ্রদ্বীপে। তার তরবারির আঘাতেই মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে যান জয়নুল খাঁ। কিন্তু যাওয়ার আগে ছুরি বসিয়ে দেন খনি বেগমের বুকে।

এভাবেই করুণ মৃত্যু হয় খনি বেগমের। শোকে পাগলপ্রায় আগা বাকের সেখানেই থাকতে শুরু করেন। এরপর এক সময় উমেদপুরের জমিদারি লাভ করেন তিনি। সেলিমাবাদ ও চন্দ্রদ্বীপের নিয়ন্ত্রণও আসে তার হাতে। ১৭৯৭ সালে ইংরেজ শাসনামলে তার নামেই বর্তমান বরিশাল জেলার নামকরণ করা হয়েছিল বাকেরগঞ্জ। পরে অবশ্য মুর্শিদকুলি খাঁর উৎসাহে অন্যত্র বিয়ে করেছিলেন বাকের। সেখানে তার দুই পুত্র আগা সাদেক ও মির্জা মাহদীর জন্ম হয়।

তবে খনি বেগমের স্মৃতি কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি বাকের। তাই তার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত রুটি ধরনের খাবারটির নাম রাখেন ‘বাকের-খনি’। সেটিই কালক্রমে পরিচিত হয় বাকরখানি নামে। বাকরখানি স্থানীয়ভাবে অনেকের কাছে শুকা, নিমশুকা রুটি নামেও পরিচিত। পাতলা করে রুটি বেলে তন্দুরের ভেতর সেঁকে একটির পর একটি লোহার শিক দিয়ে রুটিগুলো তুলে নেওয়া হয়।

বাকরখানির প্রকার ভেদ মূলত দুই ধরনের বাকরখানি চোখে বেশি পড়ে। একটি নোনতা, অপরটি মিষ্টি। এ ছাড়াও রয়েছে পনির, কালোজিরা ও কিমার বাকরখানি। পুরান ঢাকায় বিভিন্ন বাকরখানি দোকানে গিয়ে কয়েকজন কারিগরের দেখা মেলে, যারা বংশপরম্পরায় বানিয়ে চলেছেন বাকরখানি। বেশিরভাগ দোকানেই দিনে অন্তত ২০-৩০ কেজি বাকরখানি বানানো হয়ে থাকে। নাজিমউদ্দিন রোডের নাসু ফারুকের সেরা বাকরখানি নামে একটি দোকান সাত ধরনের বাকরখানি প্রস্তুত করে থেকে। মিষ্টি, নোনতা, পনির, ঘি, খাস্তা, মিষ্টি ঘি ও ঝাল বাকরখানি।

পুরান ঢাকাবাসীদের কাছে চায়ে ডুবিয়ে খাওয়ার জন্য নোনতা বাকরখানির তুলনা নেই বললেই চলে। এটি মচমচে ধরনের হয়। মিষ্টি বাকরখানির পাশাপাশি মিষ্টি ঘিয়ের বাকরখানিও রয়েছে। এতে সাদা এলাচ ব্যবহৃত হয়। তবে চমকপ্রদ আরেকটি প্রকরণ হলো ঝাল বাকরখানি, যা ঝুরা ও কিমা বাকরখানি নামেও পরিচিত। কোরবানি ঈদের সময় প্রচুর মাংস পাওয়া যায়। এই মাংস জ্বাল দিতে দিতে ঝুরা ঝুরা হয়ে গেলে তা দিয়ে পুর দেওয়া হয় বাকরখানির। এভাবে তৈরি হয় ঝাল বাকরখানি।

হেকিম হাবিবুর রহমান তার ‘ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে’ গ্রন্থে ‘শুকি ও নিমশুকি রুটি’ তথা বাকরখানির উল্লেখ করেছেন। আরেক প্রকার বাকরখানির উল্লেখ করেছেন তিনি। নাম ‘গও জোবান’। তার লেখা থেকে ‘কাশ্মিরি’ বাকরখানির কথাও জানা যায়। গোল নানরুটির মতো দেখতে এই বাকরখানি হয় কয়েক স্তরযুক্ত। মুচমুচে স্বাদের এই বাকরখানিতে দেওয়া হয় তিলের বীজ।

হেকিম হাবিবুর রহমান বাকরখানি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়েও বইয়ে আলোকপাত করেছেন। তার লেখা থেকে জানা যায়, খামির তৈরির জন্য ময়দার ডোকে ভালোভাবে মথে নিতে হবে। এরপর ময়দার সঙ্গে মাওয়া মিশিয়ে তা এমনভাবে দলে নিতে হবে যেন তীব্র শীতের মাঝেও দলতে থাকা কারিগরের কপালে দেখা দেয় বিন্দু বিন্দু ঘাম।

বর্তমানে পুরান ঢাকার কারিগররা ময়দা, তেল-ডালডা, পানি ও তন্দুর ব্যবহার করে বাকরখানি তৈরি করে থাকেন। এজন্য প্রথমে সব উপকরণ মিশিয়ে খামির তৈরি করে নিতে হবে। এরপর সেখান থেকে ছোট ছোট কোয়া কেটে আলাদা করে নিতে হবে। এরপর বেলন দিয়ে বেলে গোলাকৃতির করে নিতে হবে। মাঝখান বরাবর ছুরি দিয়ে লম্বা তিনটি দাগ দিয়ে নিতে হবে। এরপর সামান্য পানির প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকে দিতে হবে। এরপর ৫ থেকে ৭-৮ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এর ভেতরই তৈরি হয়ে যাবে সুস্বাদু বাকরখানি।

আনিস আহমেদের এক লেখা থেকে জানা যায়, মুঘল আমল থেকেই এই খাবারের প্রচলন পুরান ঢাকায় ছিল। সে সময় দুধরনের বাকরখানি পাওয়া যেত। গোল ও গাওজোবান। গাও অর্থ গরু ও জোবান অর্থ জিহ্বা। গরুর জিভের আকৃতির হওয়ায় এমন নাম। আর হেকিম হাবিবুর রহমান তার ‘ঢাকা পাচাস বারাস পেহলে’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকা ছাড়া সমগ্র হিন্দুস্তানের কোথাও হিন্দু রুটিওয়ালারা বাকরখানি তৈরি করে না। ঢাকা শহরে এটি এতো বিখ্যাত যে, সমগ্র বাংলায় এখান থেকে তা সওগাত হিসেবে প্রেরণ করা হয়।’

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version