-->
ফসলি জমিতে ইটভাটা

বছরে নষ্ট ১ শতাংশ কৃষিজমি

শাহীন রহমান
বছরে নষ্ট ১ শতাংশ কৃষিজমি

আইন অমান্য করে যত্রতত্র ফসলি জমিতে ইটভাটা তৈরি করায় প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষি জমি হারাচ্ছে। সেইসঙ্গে মাটির উর্বরতাও নষ্ট হচ্ছে টপ সয়েল ব্যবহার করে ইট প্রস্তুত করায়। সম্প্রতি এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে দেশে যত ইটভাটা গড়ে উঠেছে, তার ৪৪ শতাংশই অবৈধ। এসব ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। আর যেসব ইটভাটা বৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলোও পরিবেশবান্ধব উপায়ে পরিচালনা করা হচ্ছে না। ফলে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসলি জমির মাটির উপরি অংশ কাটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমির ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকাংশে কমে যাবে। একপর্যায়ে এসব জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা।

হাউসিং এবং বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, দেড় হাজার কোটি ইট তৈরিতে ১২৭ কোটি ঘনফুট মাটির প্রয়োজন হয়। যার সবই কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে সংগ্রহ করতে হয়। অথচ একের অধিক ফসলি জমিতে ইটভাটা তৈরি নিষিদ্ধ। দেশে যত ইট ব্যবহার করা হয়, তার সবই কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি পুড়িয়ে তৈরি করতে হয়। এতে প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। বেশিরভাট অবৈধ ইটভাটা গড়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। ফলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ইটভাটা তৈরিতেও কোনো নীতিমালা অনুসরণ করে না। ইটভাটার বেশিরভাগ মালিক পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেন না।

দেশে ইট পোড়ানো মৌসুম চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত এবং অবৈধ ইটভাটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দেশের বিভিন্ন এলাকায়; বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, লোকালয় ও বনাঞ্চলের আশপাশে, পাহাড়ের পাদদেশে এবং দুই বা তিন ফসলি কৃষিজমিতে ইটভাটা পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া অনেক ইটভাটায় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে না। এর ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়সহ জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিবেশগত ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স ব্যতিরেকেই দেশের বিভিন্ন ভাটায় অবৈধভাবে ইট পোড়ানো হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, ইটভাটা-সৃষ্ট দূষণ পরিশে বিপর্যয় ও জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। দেশে গাছ লাগনো একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ইটভাটায় নির্বিচারে কাঠ পোড়ানো। আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার, নির্ধারিত মাত্রার সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহার, জ্বালানি হিসাবে কাঠ ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং সংশ্লিষ্ট আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাটা-সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ইটভাটাসংশ্লিষ্ট আইন বাস্তবায়নের ভাটার মালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, চলতি মৌসুমেও সরকার কর্তৃক দুই দশক পূর্বে নিষিদ্ধ স্বল্প উচ্চতার ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটা এখনো চলছে। এছাড়া ১২০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনি ইটভাটার কার্যক্রম চলছে। সম্প্রতি পরিবেশ সংগঠন পবা থেকে সারা দেশে ইটভাটার সরেজমিন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে ভাটার অবস্থান, ধরন, প্রযুক্তি ও দূষণজনিত তথ্যাদি সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনের আওতায়ও পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন থেকে ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র ও লাইসেন্স এবং অবস্থান ও ধরন সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যাদির বিশ্লেষণ করে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে জ্বালানি কাঠ এবং নিম্নমানের কয়লা। এতে উজাড় হচ্ছে বন, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ইটভাটা-সৃষ্ট দূষণে গর্ভবতী মা, বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। কালো ধোঁয়ার কারণে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও ঠান্ডাজনিত নানা রোগ বাড়ছে। ইটভাটা-সৃষ্ট দূষণ পরিবেশ বিপর্যয়সহ কৃষি উৎপাদন ও ফলমূলের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত এবং গাছপালার স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে শহর এলাকায় বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইটভাটা এবং যানবাহনের ধোঁয়া। ঢাকা বাযুদূষণকারী নগরীগুলোর অন্যতম। ঢাকার আশপাশে শত শত অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এতে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের পরিবেশ মারাত্মক দূষিত হচ্ছে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে ঢাকার উপকণ্ঠ এবং সেইসঙ্গে রাজধানী ঢাকা।ইটভাটায় ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর ও সারযুক্ত টপসয়েল বা উপরিভাগের মাটি। এতে জমির উর্বরতা শক্তি ও ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, ফসলি জমির মাটির উপরি অংশ কাটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জমির ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকাংশে কমে যাবে। একপর্যায়ে এসব জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব অবৈধ ইটভাটার আগ্রাসনে বিনষ্ট হচ্ছে তিন ফসলি জমি। অপরিকল্পিত ইটভাটা জমির সর্বনাশ ডেকে আনছে, যা কৃষিনির্ভর জনবহুল দেশের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। ইটভাটা-সৃষ্ট দূষণ এবং কৃষি উর্বর মাটির অবক্ষয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে এ সেক্টরে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনয়ন অত্যন্ত জরুরি। অন্যতম নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ইটের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবেশগত দূষণমাত্রা, অবক্ষয়, শস্যের ফলনহানি এবং সর্বোপরি জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় ইটভাটার দূষণকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা ৮ হাজার ৬৫। এর মধ্যে ৫ হাজার ২৩৪টির (৬৫ শতাংশ) পরিবেশগত ছাড়পত্র রয়েছে। ২ হাজার ৮৩১টির (৩৫ শতাংশ) পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। ইটভাটার ধরন বিবেচনায় ১২০ ফুট স্থায়ী চিমনিবিশিষ্ট ভাটা ২ হাজার ১১৬টি (২৬ শতাংশ), জিগজ্যাগ কিলন ৫ হাজার ৮১২টি (৭২ শতাংশ), উন্নত প্রযুক্তির ইভাটার রয়েছে ১৩৭টি (২ শতাংশ)। তারা জানায়, ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটায় মৌসুমে গড়ে ২০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। প্রতি ভাটায় ৪০ হাজার মন কাঠ লাগে। এছাড়া ১২০ ফুট চিমনিবিশিষ্ট ভাটায়ও কাঠ পোড়ানো হয়। ইটভাটায় মোট ১৪ লাখ টন কাঠ পোড়ানো হয়। কয়লা পোড়ানো হয় ৮৯ লাখ ৫৫ হাজার টন। এ কয়লার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হচ্ছে। এতে সালফারের পরিমাণ ৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের সীমাবদ্ধতার জন্য এক ফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কৃষিজমির উপরিভাগের মাটির পরিবর্তে নদী বা খাল পুনর্খনন করা মাটি ইটভাটায় ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে এবং পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিটের ব্লকের স্থাপনা নির্মাণ পর্যায়ে ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে পরিবেশ ও কৃষিজমির অবক্ষয় রোধে তা ভূমিকা রাখতে পারবে। সম্প্রতি টিআইবির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ এর ধারা ৫-এর যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় কৃষি ও উর্বর জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইট তৈরি চলমান থাকায় মাটি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোড়া ইটের ব্যবহার যেমন পরিবেশকে দূষণ করছে। তেমনি পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের পোড়ানো পোড়া ইটের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ব্লক ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। পরিবেশবান্ধব ব্লক উৎপাদনের জন্য রূপান্তরের কাজ এখনই শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

মন্তব্য

Beta version