ত্রিভুজ আকৃতি দেয়ালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সাত বীরশ্রেষ্ঠের ম্যুরাল। বিপরীত পাশের দেয়ালে শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধের ছবি।
আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনাপ্রবাহের দৃশ্য। দুই দেয়ালের মাঝে জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল আকারের দুটি ছবির মধ্যে বড় আকৃতির ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড লাগানো হয়েছে।
এ ডিসপ্লেতে পুরো স্থাপনার সিসিটিভির চিত্র দেখা যায়। যে কেউ এখানে গেলে একটু থামতেই হবে। আসলে এটি কোনো প্রতিষ্ঠিত মিউজিয়াম নয়।
বলছি রাজধানীর বনানীর আন্ডারপাস ‘সুরসপ্তক’-এর কথা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব- সবকিছুই নান্দনিকতায় তুলে ধরা হয়েছে এই আন্ডারপাসের দেয়ালজুড়ে।
ছোট্ট পরিসরের এই আন্ডারপাসে আছে মিউজিয়াম অংশও। একটি আন্ডারপাস এত সুন্দর হতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন।
এই আন্ডারপাসে প্রবেশ করা মানেই মনে হবে উন্নত দেশের কোন স্থাপনা। এর আগে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আন্ডারপাসটি ‘প্রজাপতি গুহা’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। সৌন্দর্যের দিক থেকে সেটিও বেশ আলোচনা তৈরি করেছিল।
রাজধানীতে রাস্তা পার হতে গিয়ে নিয়মিতই ঘটে দুর্ঘটনা। দিন দিন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা। ব্যস্ত সড়কগুলোতে পর্যাপ্ত ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস না থাকা, চালকদের বেপরোয়া আচরণ এবং সাধারণ মানুষের অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তাগুলোর মধ্যে অন্যতম মহাখালী-এয়ারপোর্ট সড়ক।
এ সড়কে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজসংলগ্ন এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড়, ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন আন্ডারপাস ‘সুরসপ্তক’। সাত বীরশ্রেষ্ঠের স্মরণে এর নামকরণ করা হয়েছে।
আন্ডারপাসটি ঘুরে দেখা যায়, এর ওপরের অংশে স্বচ্ছ কাচ থাকায় সূর্যের আলো এবং রাতে চাঁদের আলো প্রবেশ করে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ আন্ডারপাস। এর উচ্চতা ১৫ মিটার। সুড়ঙ্গের মুখই এ আন্ডারপাসের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ। এখানে এক সারিতে ১০ জন পথচারী হেঁটে চলাচল করতে পারবেন। কয়েকজন সেনা সদস্য এটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন।
পথচারীদের সুবিধায় এখানে রয়েছে সিঁড়ি, এস্কেলেটর ও লিফট। এ আন্ডারপাসের দুই দিকে দুটি করে চারটি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ আছে। দৃষ্টিনন্দন আন্ডারপাসটিতে হুইলচেয়ার বা ট্রলি নিয়ে ওঠানামার ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে অসুস্থ, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও শিশুরা সহজেই এই আন্ডারপাস ব্যবহার করতে পারবে।
পথচারীরা জানান, এ আন্ডারপাসে শুধু সাধারণ পথচারীদের নয়, কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, হাসপাতালসহ সবার জন্য সড়ক পারাপার আরো নিরাপদ হয়েছে। যে কারণে এই স্থানে আর সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম।
স্থানীরাও বলছেন, নিরাপদ পারাপার নিশ্চিত করতে এই স্থাপনাটি চালু হয়েছে। তাই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার করা ঠিক হবে না। এজন্য আরো বেশি সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন সবাই।
নিরাপদ পারাপারের জন্য নির্মিত এ স্থাপনাটির পেছনের ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। ২০১৮ সালে বর্তমান সুরসপ্তকের পাশের রাস্তা পার হতে গিয়ে জাবালে নূর পরিবহণের দুটি বাসের বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় প্রাণ হারান শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মিম।
পরে নিরাপদ সড়কের ৯ দফা দাবিতে রাজধানীসহ সারা দেশের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়ে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিগুলোর অন্যতম ছিল ঘটনাস্থলে একটি আন্ডারপাস তৈরি করা। এই আন্দোলনের ঢেউ একসময় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাইয়ে দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির পর ওই বছরের ১২ আগস্ট এ আন্ডারপাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। নির্মাণের পর গত ১২ জানুয়ারি গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই প্রতিদিন দর্শনার্থী যেমন বাড়ছে তেমনি মানুষের নিরাপদ পারাপার বাড়ছে।
আন্ডারপাস দিয়ে যাওয়ার সময় মিউজিয়ামের অংশে চোখ আটকে যায় পথচারীদের। দেখা যায় এক বন্ধু আরেক বন্ধুর ছবি তুলছেন। অনেকে পরিবার নিয়ে ছবি তুলছেন। এ ছাড়া পুরো আন্ডারপাসের বিভিন্ন জায়গায় দেয়ালে প্রকৃতি, নগরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনাপ্রবাহের পুরোনো ছবি রয়েছে।
আন্ডারপাস ব্যবহার করে কুর্মিটোলা হাসপাতালের দিকে যাওয়ার সময় দেখা হয় পথচারী বিপ্লবের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘এই প্রথম এত সুন্দর আন্ডারপাস দেখলাম। শুনেছি এটা দেশের সব থেকে বড় আন্ডারপাস। রাস্তায় এত সুন্দর আন্ডারপাস বানানো হলে মানুষ অবশ্যই এটা ব্যবহার করবে। আমার কাছে মনে হয়েছে বিদেশে আছি।’
একই কথা বললেন পাখি নামের আরেকজন। তিনি বলেন, ‘আন্ডারপাসটি ব্যবহার করতে ভালো লাগে। এটি চালু হওয়ার পর থেকে নিয়মিত রাস্তা পারাপারে ব্যবহার করছি। নিরাপদ বোধ করি সব সময়। আমার আহ্বান থাকবে কেউ যেন আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার না হন।’
গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম তার ভেরিফাইড ফেসবুকে লিখেছেন, দেশের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক আন্ডারপাস সুরসপ্তক। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাত বীরশ্রেষ্ঠের স্মরণে এর নাম রাখা হয়েছে ‘সুরসপ্তক’।
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের এমইএস মোড়ে এটির অবস্থান। ৪২ মিটার দীর্ঘ চারটি সুড়ঙ্গ দিয়ে সুরসপ্তক আন্ডারপাসে চলাচল করা যাবে। এর উচ্চতা ১৫ মিটার। এক সারিতে প্রায় ১০ জন পথচারী হেঁটে চলাচল করতে পারবেন। এখানে রয়েছে সিঁড়ি, এস্কেলেটর ও লিফট। দিনে সূর্য ও রাতে চাঁদের আলোয় আলোকিত হবে আন্ডারপাসের ভেতরের অংশ। এ আন্ডারপাসের দুইদিকে দুটি করে চারটি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ আছে।
৪২ মিটার বক্স সেকশনের এই আন্ডারপাস নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ও ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।
জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর বলেন, এই আন্ডারপাসটি একটি মিউজিয়ামের আদলে তৈরি করা হয়েছে। এখানে নাগরিকদের জন্য আধুনিক সব সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি স্থাপনে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী আগামী এক বছর পর্যন্ত এটা দেখাশোনা করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারপরও যদি সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধান করতে চায়, সেটি আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে দেওয়া হবে।
মন্তব্য