-->

একুশের ৭০ বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক
একুশের ৭০ বছর
প্রতীকী ছবি

অঙ্গীকারের মাস ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে সমাজ ও রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেওয়ার শপথ নেওয়ার মাস। আজ ৭০ বছরেও যা করা যায়নি, তা হলো- অফিস-আদালতসহ সর্বক্ষেত্রে বাংলাকে ছড়িয়ে দেওয়া।

এ নিয়ে যদিও উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলেও ভাষার নানা প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা হয়। ফেব্রুয়ারি গেলেই আবারও আগের নিয়েমে সবকিছু থেমে যায়।

আরেকটি সর্বস্তরের মানুষের দাবি ছিল বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। যার ধারাবাহিকতায় করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। কিন্তু দুনিয়াজুড়ে বাংলা ভাষার প্রচলনে এ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় ভূমিকা না থাকায় খোদ ভাষা সংগ্রামীদের কষ্টের যেন শেষ নেই।

ফেব্রুয়ারি এলে মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দরদ অনেকটাই বেড়ে যায়। কারণ এ সময়ে আমরা ১৯৫২ সালের স্মৃতি স্মরণ করি। স্মরণ করি সেসব অকুতোভয় সংগ্রামীকে, যারা ভাষার জন্য রাজপথে নেমেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন।

বাংলা ভাষার প্রতি প্রচণ্ড মমত্ববোধের প্রকাশ ঘটে ফেব্রুয়ারির নানা আয়োজনে। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ঋদ্ধ আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলা। কিন্তু এবারের গ্রন্থমেলায়ও থাবা বসিয়েছে তৃতীয় দফার করোনার ধাক্কা। শেষ পর্যন্ত গ্রন্থমেলা হবে কিনা?

এ নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে সর্বশেষ মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারি) বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রকাশকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে প্রকাশকরা ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত গ্রন্থমেলা করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবে রাজী হলেও সবকিছু নির্ভর করছে আগামী দিনে করোনা পরিস্থিতির ওপর। তবে লেখক সমাজ ইতোমধ্যেই বাংলা ভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসা জানিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাস রচনা করেছেন অতীতের মতোই। সেগুলো বই আকারে প্রকাশের প্রক্রিয়াও শেষ পর্যায়ে।

গ্রন্থমেলার মতো এবারের একুশ উদযানও হয়তো অনেকটাই নিষ্প্রাণ হবে। করোনার কারণে ইতোমধ্যে একুশে উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে অনেক আগেই ঘোষণা এসেছে ভাষা শহীদদের শ্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রবেশে করোনা সনদ লাগবে।

এমনকি সামনের দিনে করোনা পরিস্থিতি আরো অবনতি যদি হয়, তাহলে অনুষ্ঠানে প্রবেশাধিকার হয়তো আরো সংরক্ষিত করা হবে। সব মিলিয়ে একুশের ৭০ বয়সের দিনগুলো ভালো যাচ্ছে না।

তবু প্রাণঘাতী এ ভাইরাস জয় করার প্রত্যয় নিতে হবে সবাইকে। জেগে উঠতে হবে একুশের চেতনায়।

আমরা এখন প্রযুক্তি বিশ্বে বসবাস করছি। ইন্টারনেট, ফেসবুক ছাড়া আমাদের চলে না। এ সময়ে এসে আমরা কি ইংরেজির প্রতি আরো অনুরক্ত হয়ে পড়ছি?

মোটেই নয়, বরং দিনে দিনে আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা চর্চায় আরো নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠছি। এর উদাহরণ পাওয়া যায় ফেসবুকে লাখো লাখো বাঙালির নানা পোস্ট ও স্ট্যাটাস দেখেই।

লক্ষ করলে দেখতে পাই, বছর কয়েক আগেও যেখানে ইংরেজিতে মানুষ মনের ভাব ফেসবুকে প্রকাশ করত, এখন বেশিরভাগ মানুষ বাংলা অক্ষর ও বাংলা ভাষা ব্যবহার করেই তার মনের ভাব প্রকাশ করছেন।

এটা যে শুধু বাংলাদেশে বসবাসকারীরা করছেন, তা কিন্তু নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাংলাভাষী মানুষও বাংলায় তাদের ভাব প্রকাশ করছেন।

ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক নিজের লেখায় বলেছেন, ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় খাজা নাজিম উদ্দিন বললেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তার ওই ভাষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করে।

৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ওই সংগঠনের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ওই পরিষদে সরকারবিরোধী সব দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসের প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হয়।

৪ ফেব্রুয়ারি আমতলার কলাভবনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- ২১ ফেব্রুয়ারি বাজেট অধিবেশন বসবে, সেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হবে সভা-সমাবেশ। ২১ ফেব্রুয়ারির সভা-সমাবেশ ঘিরে নেওয়া হয় ব্যাপক প্রস্তুতি, তা পাকিস্তান সরকারকে ভীত করে ফেলে।

২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সরকারের পক্ষে ঘোষণা করা হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে মাসব্যাপী ঢাকায় জারি থাকবে ১৪৪ ধারা। সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ। ওই ঘোষণা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আরো উত্তেজিত করল। ঘোষণা দেওয়া হয়- ১৪৪ ধারা ভাঙার এবং একুশের সব কর্মসূচি পালন করার।

কিন্তু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সভা করে সিদ্ধান্ত নিল- সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া ঠিক হবে না।

ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন আবুল হাশিম। কিন্তু আবদুল মতিন, অলি আহাদ, গোলাম মাওলা প্রমুখ ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, সাধারণ ছাত্ররা তা মানবে না। অতএব ২১ ফেব্রুয়ারির আমতলার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।

২১ তারিখ এ পরিস্থিতিতে আমতলায় সেই সভায় শামসুল হক সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছিলেন। তখন তার কথা কেউ শুনতে চায়নি। আবদুল মতিন স্পষ্ট ঘোষণা দিলেন- ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে।

তখন তাৎক্ষণিক ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়ে বলা হলো, ১০ জন করে মিছিল করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মিছিলও শুরু হয়ে যায়।

অন্যদিকে সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে সমাবেশের প্রস্তুতি চলছিল। প্রায় অপরাহ্ণে ওই সমাবেশে পুলিশ অতর্কিত গুলি চালায়। রফিক, জব্বার, বরকতসহ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। আমার হিসেবে শহীদ হন ছয়জন।

মন্তব্য

Beta version