-->

ভাষা আন্দোলনের উত্তর-প্রভাব

নিজস্ব প্রতিবেদক
ভাষা আন্দোলনের উত্তর-প্রভাব
প্রতীকী ছবি

‘বিষয়টা মাঝেমধ্যে উল্লিখিত হলেও জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এ সম্বন্ধে আরো কিছু বলা প্রয়োজন। পুনরুক্তি সত্ত্বেও বলতে হচ্ছে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে যে চারিত্র বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটে তা ছিল একাধারে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিবাদী । সঙ্গে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি যোগ করলে বোধ হয় ভুল হবে না, হবে বাড়তি সংযোজন। কারণ, অসাম্প্রদায়িকতা ও সেক্যুলারিজম প্রায় তুল্যমূল্য’।

ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানবাদী তথা ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবাদী যে সাহিত্যচর্চা বিভাগপূর্বকালে (মূলত চল্লিশের দশকে) পাকিস্তানপন্থী সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের একাংশকে পেয়ে বসেছিল (রেনেসাঁ সোসাইটি, ১৯৪২ এবং পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ, ১৯৪৩ স্মর্তব্য) তা একধরনের উন্মাদনায় পরিণত হয় ‘ওড়াও মোদের কওমী নিশান’ ও ‘জিন্দা পাকিস্তান’ জাতীয় প্রচার-পঙ্তিমালার দৌলতে। তখন হাতে গোনা কিছুসংখ্যক সাহিত্যকর্মী ছাড়া সবাই ওই মিছিলে শরিক হন। পিছিয়ে পড়ে আধুনিকতা ও গণতান্ত্রিক প্রগতিচেতনা’।

বইতে আরো লেখা হয়েছে, ‘ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ মার্চ থেকে শুরু হলেও এর পরিণত প্রকাশ ১৯৫২ ফেব্রুয়ারিতে (২১ ফেব্রুয়ারি)। এর আগে ভাষা ও হরফ নিয়ে কম ষড়যন্ত্র ও রক্ষণশীলতার প্রকাশ ঘটেনি। ভাষাকে বিকৃত করার চেষ্টা চলেছে পাকিস্তানি সরকারের মদতে ও অর্থ-সাহায্যে। একুশের প্রভাব দেখা গেছে এসব অপচেষ্টা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রভাব সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার মতাদর্শগত ক্ষেত্রে। ঐতিহ্যবাহী বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে চল্লিশের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার প্রগতিবাদী ধারা অনুসরণের চেষ্টা জোর পায়ে হাঁটতে শুরু করে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে। একুশে-পরবর্তী সাহিত্য সম্মেলনগুলোর দিকে তাকালে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে’।

‘এদিক থেকে একুশে এনেছিল বাঁধভাঙা জোয়ার’ একথা উল্লেখ করে বইতে আরো লেখা হয়েছে, ‘তাই ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন শেষে, এপ্রিলে তার ধারাবাহিকতায় মহাসম্মেলন শেষে ওই বছরেরই আগস্ট মাসে কুমিল্লায় তিন দিনব্যাপী যে সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ছিল শাসক-বিরোধী প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ। ছিল লোকসংস্কৃতি ও প্রগতিবাদী সংস্কৃতির বলিষ্ঠ আত্মপ্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-ইকবালের গানে, লোকসংগীত ও আঞ্চলিক সংস্কৃতির প্রকাশে এবং রমেশ শীলের কবিগানে (‘যুদ্ধ ও শান্তি’) একাধারে গণতান্ত্রিক, প্রগতিবাদী ও বিশ্বমৈত্রীর চেতনা প্রতিফলিত হয়। তেমনি আলোচনায় ও বক্তৃতায়।

এ চেতনা একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিবাদী। এ ছাড়াও ওই মুক্ত চেতনার প্রকাশ দেখা গেছে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মোৎসব, এমনকি বাংলা নববর্ষের উদযাপনে’।

বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কথা উল্লেখ করে বইতে আরো লেখা হয়েছে, ‘ওই ১৯৫২ সালেই যেমন রাজনীতির অঙ্গনে সেক্যুলার ছাত্রসংগঠন ‘ছাত্র ইউনিয়ন’-এর জন্ম ও দ্রুত ব্যাপ্তি, তেমনি সংস্কৃতি-ক্ষেত্রে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদসহ একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত স্মরণে সাহিত্যচর্চায় উদার যুক্তিবাদী চেতনা প্রতিফলিত হতে থাকে। সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এমনই ধারার প্রকাশ ও বিস্তার’।

‘একই ধারাবাহিকতায় সাহিত্য কর্মের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় ১৯৫৩ সালে শহীদ দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত সংকলনে (যেমন হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’) এবং বহুসংখ্যক স্মরণিকায়-যা পরবর্তী সময়ে একধরনের ঐতিহ্য সৃষ্টি করে এগুলোকে বলা যায় ‘একুশে সাহিত্য’। এগুলো, সন্দেহ নেই অনেকাংশে তাৎক্ষণিক মূল্যের, কিন্তু আমাদের সাহিত্যকর্মের বাঁক ফেরায় এবং তখনকার প্রচলিত পাকিস্তানবাদী ধর্মীয় রক্ষণশীলতা-চিহ্নিত সাহিত্যধারা হটিয়ে দেবার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছিল’।

মন্তব্য

Beta version