-->

নির্বাচন কমিশনে বিদায়ের প্রস্তুতি

শাহীন রহমান
নির্বাচন কমিশনে বিদায়ের প্রস্তুতি
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের শেষ কর্মদিবস আগামী সোমবার। এর আগেই ইসিতে শুরু হয়েছে বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা।

নিয়ম অনুযায়ী বিদায়ের আগে নির্বাচন কমিশনের (ইসির) সকল সদস্য সিইসির নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এরপরই ইসি থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেবেন।

জানা গেছে, ১৩ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতের তারিখও নির্ধারিত হয়েছে। এরপর সোমবার শেষ কর্মদিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেবেন তারা। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি আনুষ্ঠিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে বর্তমান ইসি। যার প্রধান হন কে এম নূরুল হুদা। কমিশনের অন্য সদস্যরা ছিলেন’ মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম এবং শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ওই বছর কুমিল্লা সিটি নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে বর্তমান ইসির কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ওই নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হওয়ায় সব মহলে প্রসংশিত হয় ইসি। এরপর বিদায় নেওয়ার আগে গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন। এ নির্বাচন ছিল সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এই দুটি নির্বাচন ব্যতিরেকে বর্তমান ইসি গত ৫ বছরে যত নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে তার কোনোটিই বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। যে কারণে বিভিন্ন মহলে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ৫ বছর মেয়াদে বিতর্ক কখনোই পিছু ছাড়েনি তাদের। তাই এই গ্লানি নিয়েই বিদায় নিতে হচ্ছে তাদের।

এদিকে নতুন ইসি গঠনের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ইসি গঠনে সংসদে পাস হয়েছে আইন। আইনের অধীনে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটিও গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। যার প্রধান রয়েছেন আপিল বিভাগের বিচারক বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ইতোমধ্যে সার্চ কমিটির যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই, রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের কাছে নামের তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া আগামীকাল শনিবার সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠক করে মতামত নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।

কমিটির পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছে, আগামী ২৪ ফেব্রæয়ারির মধ্যে সার্চ কমিটি আইন অনুযায়ী যোগ্য ব্যক্তি বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত ১০ জনের নামের তালিকা থেকে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অপর চারজনকে কমিশনার হিসেবে ইসিতে নিয়োগ দেবেন। যাদের অধীনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনসহ ৫ বছর মেয়াদি বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।এদিকে বর্তমান ইসির ৫ বছর মেয়াদ শেষে ১৪ ফেব্রæয়ারি বিদায়ের আয়োজন শুরু হলেও তাদের গৃহীত অনেক পদক্ষেপ সম্পন্ন হয়নি ঠিক সময়ে। সঠিক সময়ে জেলা পরিষদসহ অনেক স্থানীয় নির্বাচন তারা সম্পন্ন করতে পারেনি।

বিদায়ের আগে ইউপি নির্বাচনই ছিল শেষ নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক কম হচ্ছে না। ইউপি নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে হয়েছে ব্যাপক সহিংসতা। গত ৭ ফেব্রæয়ারি সহিংসতার মধ্য দিয়েই শেষ হয় সপ্তম ধাপের নির্বাচন। তবে শেষ সময়ে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা বেশি হলেও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

এ ছাড়া সহিংসতার দিক দিয়ে যেমন মাত্রা অতিক্রম করেছে, তেমনি ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্বাচিত হওয়ার হার ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। প্রথম থেকে শেষ ধাপের ইউপি নির্বাচনে প্রায় শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তেমনি চেয়ারম্যান ও সদস্যসহ ১ হাজার ৬০০-এর বেশি প্রার্থী নির্বাচন ছাড়াই জয়লাভ করেন।

যা বিশেষজ্ঞরা নজিরবিহীন বলছেন। তবে ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার কথা বাদ দিলে নির্বাচন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসি ইচ্ছা করলে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব।

২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বর্তমান ইসির ভেতরে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। বিভিন্ন সময় তারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। এই বিরোধ ব্যক্তিগত বিষোদাগারে পরিণত হয়।

বর্তমান কমিশনের শপথ নেওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ইসি সচিবালয়ের ৩৩ জন কর্মকর্তার বদলি নিয়ে সিইসি নূরুল হুদা ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মধ্যে বিরোধ প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এরপর জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, সিটি নির্বাচনে সাংসদদের প্রচারের সুযোগ দেওয়া, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসে।

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও কমিশনে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে মতবিরোধ দেখা গেছে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে অন্য কমিশনারদের। মেয়াদের শেষে এসেও মাহবুব তালুকদারের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন সিইসি। প্রশ্ন তোলেন তার চিকিৎসার খরচ নিয়েও। এর জবাব দেন মাহবুব তালুকাদার।

এদিকে বর্তমান ইসির অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে বিভিন্ন মহলে। বিশেষ করে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রায়ই বিষয়টি নিয়ে সিইসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর জবাবে সিইসিও বিভিন্ন সময়ে জবাব দিয়েছেন। বলেছেন ‘রাতে ভোট দেখেনি, এ বিষয়ে কেউ অভিযোগও দেননি।’ ফলে বিষয়টি অভিযোগই থেকে গেছে। তবে তিনি তার একাধিক বক্তব্যে রাতেরবেলায় সিল মারা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছানোর কথা বলেন।

এ ছাড়াও দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি নাগরিক সমাজও সমালোচনা করে তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে।

বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি শুরু থেকে তাদের পদত্যাগ দাবি করে আসছে। তবে কে এম নূরুল হুদার কমিশনই একমাত্র কমিশন যাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি তোলা হয়। ২০২০ সালে ১৪ ডিসেম্বর দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর দেশের ৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে সংবিধানের আলোকে আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানান। তারা বলেন, ‘বর্তমান ও এর আগের নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থায় মানুষের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষের আস্থা ফেরাতে নির্বাচন কমিশন এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।’

এদিকে ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদায়ের শেষ সময়ে বেশ কিছু নির্বাচন তারা সম্পন্ন করতে পারেনি। এর মধ্যে রয়েছে জেলা পরিষদের কিছু নির্বাচন। অন্যদিকে আগের নির্বাচন কমিশন দেশের সব মানুষের হাতে স্মার্ট এনআইডি কার্ড তুলে দেওয়ার কাজ শুরু করলেও ৫ বছরের মেয়াদে সব ভোটারের হাতে তা তুলে দিতে পারেননি।

প্রবাসীদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ নিলেও বর্তমান ইসি এ কাজে সফলতা পায়নি। তবে এ বিষয়ে কে এম নূরুল হুদা পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বলেছেন, অনেক কাজ সময়ের অভাবে করতে পারিনি। কোভিড আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। নতুন কমিশন নিশ্চয় সে কাজগুলো এগিয়ে নেবে।

মন্তব্য

Beta version