-->

হুমকিতে পরিবেশ-জীবন

তৌহিদুজ্জামান জিহাদ ও ইফফাত শরীফ
হুমকিতে পরিবেশ-জীবন

মোবাইল, কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের কিছু বর্জ্য বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় যাচ্ছে দেশের বাইরে। চুক্তি অনুযায়ী এসব বর্জ্য কিনে নিচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান। বর্জ্যরে কিছু অংশের বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা হলেও বাকি অংশ অব্যবস্থাপনায় থেকে যাচ্ছে দেশেই। ফলে হুমকিতে পড়েছে দেশের পরিবেশ ও জনজীবন। দেশে অবশিষ্ট বর্জ্যরে চাহিদা না থাকায় পড়ে থাকছে যত্রতত্র। পরিত্যক্ত এই বর্জ্য হুমকিতে ফেলেছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে।

ইলেকট্রনিকস বর্জ্য বলতে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম অথবা পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি বোঝায়। এগুলো মূলত ভোক্তাদের বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম। যেমন- ফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওয়েভ, ওয়াশিং মেশিন, টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ল্যান্ডফোন, ব্লু-টুথ ইত্যাদি।

দৈনন্দিন জীবনে ইলেকট্রনিকসের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে শুরু করে নানা প্রয়োজনে মানুষ এক বা একাধিক ইলেকট্রনিকস ডিভাইস ব্যবহার করে থাকেন। এগুলো চলতে চলতে এক সময় নষ্টও হয়ে যায়। তখন পরিণত হয় বর্জে যা ইলেকট্রনিকস বর্জ্য বা ই-বর্জ্য হিসেবে পরিচিত।

সম্পতি ইলেকট্রনিকস বর্জ্যগুলোকে পুনর্ব্যবহারের জন্য গড়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। ইলেকট্রনিকস বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এই কাজে সরাসরি যুক্ত থাকেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। জুরাইন পাইপ রাস্তার ইলেকট্রনিকস বর্জ্য ব্যবসায়ী হাসান বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই পণ্যগুলোকে স্বল্পমূল্যে ক্রয় করি। এভাবে ইলেকট্রনিকস মেশিনারিজগুলোকে বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করে গুলিস্তান পাইকারি বাজারে সামান্য লাভে বিক্রি করি। এর মাধ্যমে অল্প পুঁজিতে অধিক লাভ করা যায়।’

খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই বর্জ্য বিক্রি করেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের কাছে।

গুলিস্তান হল মার্কেটের ইলেকট্রনিকস বর্জ্যের পাইকারি ব্যবসায়ী শরাফত আলী ভোরের আকাশের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মোবাইল কম্পিউটার ল্যাপটপ বøু-টুথসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিকস বর্জ্যের দেশি ও বিদেশি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি হয়। পরে ইলেকট্রনিকস বর্জ্যগুলোকে বিভিন্ন এলাকার খুচরা দোকানদারদের থেকে কিনে এনে ডিভাইস অনুযায়ী ভাগ করা হয় এবং সেগুলোকে আলাদা করে বিভিন্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইলেকট্রনিকস বর্জ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির পর তা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তুলছে দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। যার মধ্যে মোবাইল ও কম্পিউটারের কোম্পানিগুলোই সবচেয়ে বেশি। রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের পুরান মার্কেটের আবদুল্লাহ কম্পিউটার্সের মালিক শাহজাহান হাবিব জানান, বিভিন্ন সার্ভিসিং দোকান থেকে পুরাতন ও নষ্ট কম্পিউটারের মাদার বোর্ড, সিপিইউ, মাইক্রো প্রসেসর ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় কেনা হয়। পরে তা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের কাছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়।

তিনি বলেন, ‘প্রতিনিধিরা এগুলো নিয়ে চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে চায়না-কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশে পাঠিয়ে দেন। পরে সেগুলোতে যন্ত্রপাতি সংযোজন ও মোড়কীকরণের মাধ্যমে পুনরায় দেশের বাজারে বাজারজাত করা হয়।’ বৃহত্তর কম্পিউটার মার্কেট মাল্টিপ্ল্যান কম্পিউটার সিটিতে গিয়ে এই মাদারবোর্ডগুলো ক্রয়-বিক্রয় হতে দেখা গেছে। বাংলাদেশি মোবাইল কোম্পানিগুলোও অব্যবহৃত ও নষ্ট মোবাইলের মাদারবোর্ডগুলো কিনছে বলেও তথ্য পাওয়া যায়। রাজধানীর সুন্দরবন স্কয়ারের জালাল এক্সেসসোরিস দোকানের মালিক জালাল উদ্দিন জানান, ‘দেশীয় মোবাইল কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রতিদিনই মার্কেটে আসেন। তারা আমাদের কাছে থাকা পুরাতন মোবাইলের মাদারবোর্ডগুলো নিয়ে যান, যা পরবর্তী সময়ে তারাই তাদের কোম্পানির নামে মোবাইল ফোন তৈরি করে সেগুলোকে দেশের বাজারে বাজারজাত করেন। অনেক সময় চায়নাতেও মোবাইল মাদার বোর্ডগুলো পাঠানো হয়।’

মোবাইল ও কম্পিউটারের কিছু বর্জ্য ছাড়া অন্য ইলেকট্রনিকস বর্জ্যের কোনো প্রকার ব্যবস্থাপনা নেই। চাহিদা না থাকায় অব্যবস্থাপনায় থেকে যায় অনেক ইলেকট্রনিকস বর্জ্য। বেগমবাজার এলাকার খুচরা ই-বর্জ্যরে ব্যবসায়ী হাসিব বলেন, ‘বাজারে চাহিদা আছে এমন সব ইলেকট্রনিকস বর্জ্য বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয়। তবে অন্যান্য বর্জ্যরে চাহিদা না থাকায় সংগ্রহ করা হয় না।’

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকতে দেখা যায় খেলনা, ইলেকট্রনিক ট্রেন ও রেসিং কার সেট, ভিডিও গেম, খেলাধুলা ও ব্যয়ামের সামগ্রী। বর্জ্যরে এই অব্যবস্থাপনা যেমনি প্রভাব পড়ছে মানবস্বাস্থ্যের ওপর তেমনি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে ই-বর্জ্যকে `New and emerging environmental threats to human health' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন' ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে মধ্যে কিছু উপাদান মূল্যবান এবং কিছু উপাদান রয়েছে যা মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ই-বর্জ্যে থাকা এই উপাদানগুলো হলো সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, প্যালাডিয়াম, প্ল্যাটিনাম, নিকেল, টিন, লেড, লোহা, সালফার, ফসফরাস, আর্সেনিক, পলিভিনাইল ক্লোরাইড, পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইল ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-বর্র্জ্যে এক হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ থাকে এবং নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ইলেকট্রনিকস বর্জ্যগুলো পানির সঙ্গে মিশে পানি দূষণ করে, যা মানুষের শরীরে কঠিন ও জটিল রোগ তৈরি করে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিকস বর্জ্যরে মধ্যে থাকা সিসা, পারদ, কপার বেরিলিয়াম, রেফ্রিজারেটর ও এসিতে ব্যবহৃত ক্ষতিকর পদার্থ ক্যান্সার ও কিডনি নষ্ট হওয়া এবং থাইরয়েড হরমোন বিপর্যস্ত করাসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টিতে ভ‚মিকা রাখে।

ই-বর্জ্যের ক্ষতি থেকে সবার সুরক্ষায় এই বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

মন্তব্য

Beta version