-->
শিরোনাম

মহীসোপান ও সেন্ট মার্টিন নিয়ে ভারত-মিয়ানমারের আপত্তি কেন?

তরিকুল ইসলাম
মহীসোপান ও সেন্ট মার্টিন নিয়ে
ভারত-মিয়ানমারের আপত্তি কেন?

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয়েছে বেশ আগেই। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে নিষ্পত্তির পরও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মহীসোপানে আপত্তি তুলেছে ভারত। তেমনি মিয়ানমারও বেশ কয়েকবার সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মানচিত্রে নিজেদের দেখিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে।

জানা গেছে, সমুদ্র সম্পদের কারণেই মহীসোপান নিয়ে আপত্তি ভারতের। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টি ও বাংলাদেশের পক্ষে তৎপরতা বাড়লেই সেন্ট মার্টিন নিজেদের দাবি করে পুরোনো মানচিত্র উপস্থাপন করে মিয়ানমার। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো ও শক্তিশালী দেশগুলোকে আরো মিত্র করার পরামর্শ কূটনীতিকদের। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এসব সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিক নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমানে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলেও সেটা দ্বিপাক্ষিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব ফেলছে না। একইভাবে ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের বেশকিছু বিষয়ে অপ্রাপ্তি রয়েছে। সেসবে আটকে নেই দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য বিষয়। ভারত ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যু থেকে আন্তর্জাতিক মহলের চোখ ফেরানো এবং তাদের বিভ্রান্ত করতেই উভয় দেশ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন কর্মকাণ্ড করছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে বিভ্রান্তির মধ্যে রাখার কৌশল হিসেবে দুটি দেশ এসব করছে- তাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করেন তারা।

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি

২০১৪ সালের জুলাই মাসে নেদারল্যান্ডসের হেগের সালিসি আদালতে বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। ২০১২ সালের মার্চে জার্মানিতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়।

বাংলাদেশের আয়তনের সমান অধিকার লাভ

ভারতের সঙ্গে আদালতের রায়ের ফলে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশ পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে মহীসোপান অঞ্চলে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের সার্বভৌম অধিকার লাভ করেছে। যা প্রায় পুরো বাংলাদেশের আয়তনের সমান।

মহীসোপান কী

মহীসোপান হচ্ছে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর সমুদ্রের দিকে পানির নিচে যে ভূখণ্ড ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া অংশ- তাকে ভূগোলের ভাষায় মহীসোপান বলা হয়ে থাকে। যাকে উপক‚লীয় ওই দেশের বর্ধিত অংশ বলে ধরা হয়।

১৯৫৮ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর স্থলভাগের বেসলাইন থেকে লম্বালম্বিভাবে সমুদ্রের ২০০ মাইল পর্যন্ত এলাকার মালিকানা সম্পূর্ণ ওই দেশের। এরপর থেকে ১৫০ মাইল পর্যন্ত সীমার সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদের মালিক হবে ওই দেশ, তবে পানিতে থাকা মাছ ধরতে পারে অন্য দেশও। সব মিলিয়ে ৩০০ মাইলকে ওই দেশের মহীসোপান বলা হয়। দেশের আকারভেদে মহীসোপানের দৈর্ঘ্য কমবেশিও হতে পারে।

মহীসোপানে ভারতের আপত্তি

মহীসোপানের দাবিতে ২০১১ সালে জাতিসংঘের মহীসোপান নির্ধারণসংক্রান্ত কমিশনে (সিএলসিএস) আবেদন জানায় বাংলাদেশ। ২০২০ সালের অক্টোবরে দাবির বিষয়ে সংশোধনীও জমা দেয়। ২০২১ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশের দাবিকে বিবেচনায় না নিতে আপত্তি জানায় ভারত।

এদিকে ভারতের আপত্তির পরে ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিবের বরাবর একটি চিঠি দেয় বাংলাদেশ। চিঠিটিতে বলা হয়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর মহীসোপান দেশটির আপত্তির আইনগত ভিত্তি নেই। তাই, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মহীসোপান নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগও নেই।

তবে বাংলাদেশ আইনগতভাবে মহীসোপানের যতটা প্রাপ্য সেখানে আপত্তি থাকায় ঝুলে গেল মহীসোপানে একচ্ছত্র অধিকার।

মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধের কারণ

২০০৮ সালের ১ নভেম্বর মিয়ানমার ডে’ইউ (কোরিয়া) কোম্পানির ৪টি ড্রিলিং জাহাজ নিয়ে তাদের নৌবাহিনীর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় গ্যাস/তেল অনুসন্ধানের জন্য প্রবেশ করে। মিয়ানমারের এই অনুপ্রবেশের তীব্র নিন্দা জানায় এবং কূটনৈতিকভাবে তা সমাধানের চেষ্টা করে। দুই দিন পর বাংলাদেশের কূটনৈতিক চাপের মুখে মিয়ানমার তার ড্রিলিং জাহাজগুলো সরিয়ে নেয়।

অন্যদিকে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ইটলস বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা চিহ্নিত করে রায় দেয়। এতে বঙ্গোপসাগরে ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটারের ওপর বাংলাদেশ অধিকার লাভ করে। রায়ে বাংলাদেশ সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করে। তাছাড়া সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরে ৬৮৫ বর্গকিলোমিটার একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং এর বাহিরে মহীসোপানে প্রবেশের অনুমতি দেয়।

সেন্ট মার্টিন যে বাংলাদেশের অংশ তার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রমাণ সরকারের কাছে রয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ১৯৩৭ সালের মানচিত্রে সেন্ট মার্টিন ভারত উপমাহদেশের অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর সেন্ট মার্টিন ওই সময়ের পাকিস্তান অংশে ছিল।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময়েও সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের অংশে ছিল। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ সমুদ্রসীমাবিষয়ক জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (আইটিএলওএস) বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমাবিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির রায় দেন। ওই রায়েও সেন্ট মার্টিনকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

যা বলছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সমুদ্রসংক্রান্ত আইন অনুসরণ করেই নিজ ভূখণ্ডের বেসলাইন নির্ধারণ করেছে। ২০১৪ সালে আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর ভারত তখন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতে কোনো আবেদন করেনি। সে সময় উভয় দেশই এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন দিয়েছিল। এখন তাদের এই আপত্তি আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’

তিনি বলেন, ‘মহীসোপান নিয়ে ভারতের আপত্তির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, তবুও বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা জাতিসংঘে তথ্য-প্রমাণসহ একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছি। জাতিসংঘের মহীসোপান নির্ধারণসংক্রান্ত কমিশনের (সিএলসিএস) চূড়ান্ত যে সুপারিশ তা এখনো আসেনি।’

সমুদ্র অঞ্চলের সুরক্ষা এখন মূল চ্যালেঞ্জ

সমুদ্র অঞ্চলের সুরক্ষা, সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদের সঠিক জরিপ, সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিতকরণ, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ এবং সমুদ্রবিজ্ঞান ও সম্পদের গবেষণা ও অধ্যয়ন ত্বরান্বিত করা।

মানচিত্রে দুই দফায় ‘সেন্ট মার্টিন’ দ্বীপকে নিজেদের দেখায় মিয়ানমার

২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুই দফায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মানচিত্রে নিজেদের দেখিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিল মিয়ানমার। দেশটির রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইটে সেন্ট মার্টিনকে রাখাইনের অন্তর্ভুক্ত করে তথ্য-উপাত্তে পরিবর্তন করেছে তারা। সেখানে সেন্ট মার্টিনের নাম বদল করে মিয়ানমার তাদের মানচিত্রে রাখাইনের অন্তর্ভুক্ত দেখিয়ে ‘মঙটাও’ নামে অভিহিত করেছে।

এছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সীমান্তে তিন দফায় ৪১ রাউন্ড গুলি চালায় মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। ওই ঘটনায় একজন বাংলাদেশি ও একজন রোহিঙ্গা আহত হন। সীমান্তে গুলির ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত উ লুইন ও’কে তলব করা হয় এবং এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে অস্বীকার করেন তিনি। তারও আগে প্রথম দফায় সেন্ট মার্টিনকে মিয়ানমার নিজেদের বলে দাবি করার পর উ লুইন ও’কে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়ে একটি ক‚টনৈতিক চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ। সে সময়ও দেশটি ঘটনার অস্বীকার করেছিল।

দ্বিতীয় দফায় সেন্ট মার্টিনকে দাবি করার পর মিয়ানমারের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টকে তলব করা হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিস্ময় প্রকাশ করা হয় এবং কূটনৈতিক পত্র হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তাদের ভুল স্বীকার করা হয়।

দ্রুত সমাধানের আশা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

মহীসোপন নিয়ে ভারতের আপত্তিকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ভোরের আকাশকে তিনি বলেন, ‘ভারত শুধু শুধুই আপত্তি তুলেছে, এ নিয়ে আমরাও জাতিসংঘে তথ্য উপস্থাপন করেছি। আশা করি, দ্রুতই এটারও সমাধান হয়ে যাবে। এছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিভিন্ন বড় দেশগুলোর নজর রয়েছে। দেশগুলো বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে ব্যবহার করতে চায়। বাংলাদেশ এ নিয়ে চাপে রয়েছে বলেও জানান ড. মোমেন।

প্রয়োজন ‘থিঙ্ক ট্যাংক’

কূটনীতিক ও মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফায়েজ ভোরের আকাশকে বলেন, মিয়ানমার মিথ্যার আশ্রয় নিলে আমরা তা বন্ধ করতে পারব না। কিন্তু সেটাকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে আমাদের। আর এ জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম থাকা উচিত। প্রতিটি অপপ্রচার ধরে ধরে এর তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে জবাব দেবে এই প্ল্যাটফর্ম। এটি সরকারিভাবে হতে পারে, আবার বেসরকারিভাবেও হতে পারে। সরকার সবক্ষেত্রে অনেক কিছু বলতে পারে না। তাই বেসরকারিভাবেও বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বাইরে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশকে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম এখনই তৈরি করা জরুরি।

মন্তব্য

Beta version