-->

কর্মকর্তাকে অপসারণ, দুদকে তোলপাড়

জুনায়েদ হোসাইন
কর্মকর্তাকে অপসারণ, দুদকে তোলপাড়

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে সংস্থাটিতে, চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এ ঘটনায় সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীতে মানববন্ধন করেছেন দুদকের বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। ঢাকায় তারা দুদকের প্রধান কার্যালয়ে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।

এদিকে, বিষয়টি নিয়ে চলছে সংস্থাটির বাইরেও নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিষয়টিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে গিয়ে দুদক কর্মকর্তার চাকরি হারানোকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলছে ‘অশনি সংকেত’। বিষয়টিকে ‘উদ্বেগজনক’ উল্লেখ করে এ বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য দুদকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)।

কেউ কেউ বলছেন, কমিশন প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম কোনো কর্মকর্তাকে অপসারণের ঘটনার প্রতিবাদে সহকর্মীরা কর্মসূচি পালন করছেন।

তবে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের দাবি, এ ঘটনার প্রতিবাদে ‘কর্মসূচি পালন হয়েছে এমন কোন তথ্য কমিশনে নেই। এরকম কর্মসূচি পালনের তথ্য পাওয়া গেলে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বৃহস্পতিবার দুদক প্রধান কার্যলয়ে সাংবাদিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ রয়েছে, তার ভিত্তিতে দুদকের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কী কাজ করবেন, কিভাবে করবেন সব কিছুরই বিধি-বিধান রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘দুদকের উপসহকারী পরিচালক শরিফ, তিনি এই দুর্নীতি দমন কর্মচারী চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী যেসব বিধি-বিধান মানা প্রয়োজন তা না মেনে অব্যাহতভাবে বিধির পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছেন। এ কারণে কমিশন মনে করেছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে, সকলে যাতে সঠিকভাবে কাজ করে, সে লক্ষ্যে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। এটি কোন ব্যক্তি বিষয় নয়। এটি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং যাতে আমরা বিধি মেনে চলি, সেজন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তবে এই ৫৪ (২) ধারায় বিধি যে সব জায়গায় সবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে তা কিন্তু নয়। এটি আমাদের সর্বশেষ এবং চরম পর্যায়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয় তার একটা অংশ।’

পদচ্যুত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল এই প্রশ্নে সচিব বলেন, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল তা সবার সমানে বলতে চাইছি না। তবে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ছিল, অনেক অভিযোগ ছিল এবং অনেকগুলো অভিযোগ এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে চাকরিবিধি মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটি কমিশনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়েছে।

দুদক কর্মচারীদের মানববন্ধনের বিষয়ে তিনি বলেন, কারা মানববন্ধন করেছেন, তা আমার সামনে ঘটেনি। কয়েকজন কর্মকর্তা আমার কাছে এসেছেন, এবং তারা বলেছেন, কাজ করতে স্বস্তি পাচ্ছেন না। এর পরিপ্র্রেক্ষিতে আমি বলেছি, আপনার যদি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন তাহলে ভয়ের কিছু নেই। কারণ- কমিশন এত নির্দয় না। দয়া বা নির্দয়ের বিষয় না। মূল বিষয় হলো, কমিশন আইন ও চাকরিবিধি মানা। তাদেরকে বলা হয়েছে, আপনারা কাজ করেন, কারোই কোন ক্ষতি হবে না। যদি আপনি সঠিক পথে থাকেন। বিধি-বিধান পালন করেন। অন্যদিকে, পদচ্যুত কর্মকর্তা শরিফের বিষয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া এবং ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিসহ অনিয়মের বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত করে আলোচনায় আসেন শরীফ উদ্দিন। এছাড়াও চট্টগ্রামে জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ১৫৫ জনকে অভিযুক্ত করেছিলেন তিনি। এছাড়াও পেট্রোবাংলার এক প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে কাজ করেন ওই কর্মকর্তা। সর্বশেষ পটুয়াখালী দুদক কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন তিনি। সেখান থেকে গত বুধবার তাকে অপসারণ করা হয়।এদিকে ঢাকায় মানববন্ধন অংশগ্রহণকারী দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এক সহকর্মীকে ৫৪ (২) ধারায় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা ইনভেস্টিগেশন-ইনকোয়ারি করতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কাজ করতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আশা করি সম্মানিত কমিশন যৌক্তিকতা সহকারে সমস্যাগুলো দেখবেন। যেসব সমস্যা ফেস (মোকাবেলা) করি এ বিষয়গুলো সচিব স্যারের কাছে জানিয়েছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, খুব দ্রুত আমাদের বিষয়গুলো সমাধান করবেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘একটি ক্রিমিনাল প্রসিডিউর বেইজড অন ইনভিজিলেশন অ্যান্ড ইনকোয়ারি চাইলেই তাড়াহুড়া করে দেওয়া যাবে না। আমরা চাইছি এই জিনিসগুলো তারা বুঝে সমাধান দিক। আমাদের নিরাপত্তা দিক।’

দুদক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দীনকে অপসারণ করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকুরী) বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) ধারায়। এতে বলা আছে, এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোন কারণ না দর্শাইয়া কোন কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা ৯০ দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।’

অন্যদিকে, আর এই ধারাটিকে ‘বিতর্কিত’ বলে দাবি করছেন দুদক কর্মচারী-কর্মকর্তারা।

শরিফ উদ্দীনকে চাকরি থেকে অপসারণের জন্য দেওয়া দুদক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ - এর বিধি ৫৪ (২) তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা (যদি থাকে) পাবেন। কমিশনের অনুমোদনক্রমে জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হলো। যা ১৬ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ন থেকে কার্যকর গণ্য হবে।’

দুদক কর্মকর্তাদের স্মারকলিপিতে উল্লেখ রয়েছে, ২০০৮ এর ৫৪ বিধিটি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং ১৪২৪/২০১১ দায়ের করা হলে ১৭ অক্টেবর ২০১১ হাইকোর্ট বিভাগ বিধিটিকে অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করেন। রায়ের বিপক্ষে কমিশন আপিল দায়ের করলে ১০ নভেম্বর ২০১৬ সালে আপিল আদালত আপিলটি খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগের ৫৪ বিধি অসাংবিধানিক ঘোষণাটি বহাল রাখে। কিন্তু, কমিশন আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের বিপরীতে ৩২/২০১৭ সিভিল রিভিশন দায়ের করলে ২৮ নভেম্বর ২০২১ সালে শুনানি করে হাইকোর্টের আদেশটি স্থগিত করেন। বর্তমানে বিষয়টি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। তবে, দুদক কর্মচারীরা দাবি করছেন, কমিশনের রিভিশন শুনানি একতরফা বা রিটকারীর প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ভোরের আকাশের সঙ্গে কথা হয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন’র সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, দুদক কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। যেখানে আমরা বলছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। সেখানে জিরো টলারেন্স দেখানোর জন্য একজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়, তা কোনভাবে যৌক্তিকতা বোঝা যায় না এবং কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

তিনি বলেন, যারা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়ে থাকেন, তাদের চাকরির নিশ্চয়তা না থাকা একটি অশনি সংকেত। এটা আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। এটি দুর্নীতিকে আরো বেশি উৎসাহিত করবে বলে আমরা মনে করি।

এর সমাধানে যাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা এবং যারা এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন সুজন সম্পাদক।দুদক সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, অপসারণ বা চাকরিচ্যুতির ঘটনা এর আগেও হয়েছে। এখন কী হচ্ছে তা আমি বলতে পারছি না। এখন তো আমি দুদকে নাই। তাই দুদক বিষয়ে কথা বলতে চাইছি না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সংস্থার ব্যস্ততার কারণে এ বিষয়ে তিনি মতামত দিতে পারছেন না, তবে টিআইবির পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়া হবে।

এর পরপরই টিআইবি থেকে এক ইমেইল বার্তায় জানানো হয়, উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে সম্প্রতি চাকরিচ্যুতি নিয়ে সংস্থার অভ্যন্তরে এবং বাইরে বেশ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এই চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে দুদকের কর্মীদের অংশগ্রহণে মানববন্ধনের মতো ঘটনাও ঘটেছে যা যেমন অভূতপূর্ব, তেমনি উদ্বেগজনক।টিআইবির বার্তায় বলা হয়, সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য দুদকের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে টিআইবি। জনমনে তৈরি হওয়া এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে দুর্নীতি দমনে কাজ করা সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা গভীরতর সংকটের মুখে পড়বে বলে মনে করে টিআইবি। তেমনি, দুর্নীতি দমনে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা সৎ ও সাহসী কর্মকর্তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলবেন, যা দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানকেই দুর্বল করে ফেলবে, যেটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দুদক নেতৃত্ব এ বিষয়ে নিজেদের প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা দূর করবেন এমনটাই প্রত্যাশা করে টিআইবি।

 

 

মন্তব্য

Beta version