‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এবং সামনের রাস্তায় ছাত্র-পুলিশ সংঘাত এবং ছাত্রদের অবিরাম স্লোগান ও পরিষদ ভবনের সামনে পৌছানোর চেষ্টা সংহত রূপ নেয় তাদের মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে পৌঁছানোর পর। এটা ছিল পুলিশের সাথে ছাত্রদের মোকাবিলার দ্বিতীয় পর্ব।
‘প্রথম পর্ব পুলিশের হামলায় বিশৃঙ্খলভাবে শেষ হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। দুপুর বারোটার মধ্যেই ছাত্ররা হোস্টেল প্রাঙ্গণে পৌঁছে যায়। তাদের সঙ্গে কিছুসংখ্যক পথচারী ও সরকারি কর্মচারীও ততক্ষণে যোগ দেয়। তাদের অধিকাংশ রাস্তায় এবং খেলার মাঠের পশ্চিম কোনায় জড়ো হতে থাকে। তবে ছাত্রদের সবাই মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে’।
এভাবেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপঞ্জি তুলে ধরা হয়েছে ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে।
ভাষা সৈনিক আহমদ রফিকের লেখা বইয়ের ৪৬ ও ৪৭ পৃষ্ঠায় আরো রয়েছে, ‘এখান থেকে তারা সংঘবদ্ধভাবে পরিষদ ভবনের দিকে যাবার চেষ্টা করে। অনবরত স্লোগান এবং যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। ইতিমধ্যে পুলিশ বাহিনী তাদের পূর্ব-অবস্থান থেকে সরে এসে মেডিকেল হোস্টেলের সামনে গোটা ফুলার রোডজুড়ে অবস্থান নিয়েছে এবং পরিষদ ভবনে যাওয়ার পথে শক্ত ব্যারিকেড তৈরি করে রেখেছে’।
সেদিনের ঘটনা বর্ননা দিতে দিয়ে আরো বলেন, ‘সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ তথা আইনসভার বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা বেলা তিনটায়। পরিষদ সদস্যদের কেউ কেউ বা দু-একজন মন্ত্রী এ পথ দিয়ে যাবেন, এমন সঠিক ধারণা থেকেই ছাত্ররা যানবাহন অবরোধ করতে থাকে। ইতিমধ্যে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে কয়েক দফা ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি চলেছে। স্কুলছাত্রদের কেউ কেউ হোস্টেল থেকে ঢিল ছুড়েছে, পুলিশ পাল্টা ঢিল ছুড়ে জবাব দিয়েছে।
‘ছাত্রদের অনুমান ভুল ছিল না। মেডিকেল কলেজের কয়েকজন তরুণ ছাত্র ঠিকই হোস্টেলের ভেতরে নিয়ে আসে মানিকগঞ্জের এম. এল. এ আওলাদ হোসেন ও তার সঙ্গী স্থানীয় প্রতাপশালী রাজনীতিক রাজা মিয়াকে। উদ্দেশ্য, বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করানো, প্রৌঢ় আওলাদ হোসেনকে ছাত্রদের দাবি মেনে তবেই মুক্তি অর্জন করতে হয়। মন্ত্রী হাসান আলীকে পুলিশের বেদম লাঠিবাজির কারণে গাড়ি থেকেই নামাতে পারেনি ছাত্ররা।’
ঘটনার বিবরণে আরো বলা হয়, ‘হোস্টেল প্রাঙ্গণে টিয়ারগ্যাসের ঝাঁজালো ধোঁয়ার মধ্যে অবিরাম উচ্চারণ 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' 'রাজবন্দীদের মুক্তি চাই' 'পুলিশি জুলুম চলবে না' ইত্যাদি। পুলিশের সুদৃঢ় বাধার কারণে ছাত্রদের সংঘবদ্ধ চেষ্টা সত্ত্বেও পরিষদ ভবনের সামনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবু চেষ্টার বিরাম নেই। মাঝেমধ্যে ইট পাটকেলবৃষ্টি-উভয় দিক থেকেই’।
আন্দোলনের উত্তাপ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে সেদিনের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে আরো লেখা হয়েছে, ‘ দুপক্ষেই উত্তাপ বাড়ছে। শুধু স্লোগান নয়, হোস্টেলে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের মাইকে মেডিকেল ছাত্রদের অবিরাম ঘোষণা, সংগ্রামের আহ্বান, ছোট ছোট কথিকা ও কবিতা আবৃত্তি চলছে। লক্ষ করার বিষয় যে এ পর্যায়ে ছাত্রদের তৎপরতা ছিল একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত।
`বেলা যত বাড়ছে এদিকে ছাত্রদের, অন্যদিকে পুলিশের তৎপরতা একইভাবে বেড়ে চলেছে। টিয়ারগ্যাসের ঝাঁজে প্রাঙ্গণের বাতাস ঝাঁজালো। তা সত্ত্বেও অকুস্থলে জনসমাগম বাড়ছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী অনেকেই হোস্টেল-প্রাঙ্গণের জনসংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করেছে।’
বলা হয়, ‘পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার এমনই এক সংঘাতের পর্যায়ে বেলা তিনটার কিছুক্ষণ পর বিনা প্ররোচনায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের বেশ কয়েক দফা গুলিবর্ষণ। যেমন হোস্টেলে সমাবেশের ওপর তেমনি রাস্তার এক কোণে দাঁড়ানো ছাত্রজনতার ওপর।
‘অকুস্থলে উপস্থিত ঢাকার অবাঙালি জেলা ম্যাজিট্রেট কোরাইশি, সিটি এস.পি. মাসুদ, বাঙালি পুলিশ ডি.আই.জি ওবায়দুল্লাহ, এস.পি. মুহম্মদ ইরিস, ডি.এস.পি সিদ্দিক দেওয়ান প্রমুখ। গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা সবাই মিলে নিয়েছিলেন।’
মন্তব্য