# ইংরেজিতে লেখা রায় বাংলায় অনুবাদ চলছে নতুন অ্যাপে
স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাবাস-একথা উল্লেখ না থাকলে যাবজ্জীবন সাজা অর্থ ৩০ বছরের কারাদণ্ড-এই ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের ১২০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছে গত বছর ১৫ জুলাই। তবে তা প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে।
এই পুরো রায়টি এখন বাংলায় প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। এরই মধ্যে রায়টি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। রায়ে ভুলত্রুটি আছে কি না তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা অনুমোদন দিলেই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন তা বাংলায় প্রকাশ করবে।
শুধুই এই একটি নয়, এ রকম অনেক রায়ই বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশের কাজ চলছে। এরই মধ্যে ১৬টি রায় বাংলায় সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ সংক্রান্ত সফটওয়্যার ‘আমার ভাষা’র মাধ্যমেই এসব রায় বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। ফলে উচ্চ আদালতের রায় বা আদেশ সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য করে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এই ‘আমার ভাষা’ অ্যাপটি আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে।
মাতৃভাষা ‘বাংলা’র জন্য রক্তদানের স্বীকৃতি হিসেবেই একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলা ভাষা আজ খোদ বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে প্রায় উপেক্ষিত।
হাতে গোনা কয়েকজন বিচারপতি বাদে প্রায় সকলেই রায় বা আদেশ দিচ্ছেন ইংরেজিতে। আইনজীবীরাও আবেদন ও শুনানি করেন ইংরেজিতে। উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় বা আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েক বছর আগে বিচারপতিদের মধ্যে যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল তা সে তিমিরেই রয়ে গেছে।
তবে উচ্চ আদালতের ইংরেজিতে লেখা রায় বা আদেশ বাংলায় অনুবাদের জন্য গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারির আগে ‘আমার ভাষা’ নামে একটি অ্যাপ উদ্বোধন করা হয়। এই ‘আমার ভাষা’ অ্যাপটিই এখন আশার আলো দেশের সাধারণ মানুষের কাছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমার ভাষা’ অ্যাপটির মাধ্যমে ইংরেজিতে লেখা রায় বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা অব্যাহত রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, এক বছর আগে ‘আমার ভাষা’ নামের সফটওয়্যারটি দিয়ে ইংরেজি রায় বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে। কার্যত সাধারণ মানুষ যাতে সহজেই রায় বুঝতে পারেন সে জন্যই এই উদ্যোগ।
তিনি বলেন, একটি রায় ইংরেজি থেকে বাংলায় করতে বেশ সময় লাগে। কোনো ভুল হচ্ছে কি না, আইনের ব্যাখ্যা ভুল হচ্ছে কি না তা দেখে দেওয়ার পর সঠিকভাবে অনুমোদন দেন বিচারপতিরা। এরপর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
গত বছর ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ সংক্রান্ত সফটওয়্যার ‘আমার ভাষা’ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এমপি বলেছিলেন, এতদিনে বাংলাদেশের সকল আদালতের সকল কার্যক্রম বাংলা ভাষাতেই হওয়া বাঞ্চনীয় ছিল। তবে উচ্চ আদালতে শতভাগ বাংলা ভাষার প্রচলন করার বাস্তবসম্মত অসুবিধা এখনো রয়েছে। তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক আমল থেকে আদালত সমূহের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষাতে পরিচালিত হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আলোচিত মামলার রায় বই আকারে (ডিএলআর) প্রকাশের দায়িত্বে (ডিএলআর সম্পাদক) থাকা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ভোরের আকাশকে বলেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন মামলায় রেফারেন্স হিসেবে যেসব বিদেশি রায় উল্লেখ করা হয় তার সবই ইংরেজি ভাষায়।
এছাড়া আমাদের যেসব রায় বা আদেশ বিদেশে পাঠাতে হয় বা বিদেশিরা ব্যবহার করে তা ইংরেজিতে লিখতে হয়। এ কারণেও ইংরেজির ব্যবহার হয় উচ্চ আদালতে। তিনি বলেন, বাংলা ভাষায় রায় দিতে পারলে আমাদের দেশের মানুষের জন্য ভালো হতো।
বাংলায় ডিএলআর প্রকাশে বাধা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালেল দিকে ২/৩টি সংস্করণ বাংলায় করা হয়েছিল। কিন্তু আইনজীবীরা তা কিনতে উৎসাহবোধ করেননি। এরপর থেকে আর বাংলায় ডিএলআর প্রকাশ করা হয়নি। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লিখে ডিএলআর প্রকাশে বাধা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত চর্চার অভাবে তা হয়ে ওঠে না।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে থাকা ৯৩ জন বিচারপতির মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন। বিশেষ করে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামসহ বেশ কয়েকজন বিচারপতি কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বাংলায় রায় বা আদেশ দিচ্ছেন।
সংবিধান অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালে প্রনীত হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন (১৯৮৭ সালের ২ নং আইন)’।
এ আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে,‘‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন, আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।’
একই আইনের ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘৩(১) উপ-ধারায় উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বে-আইনী ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।” আর সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে ‘আদালত’ অর্থ সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের যে কোনো আদালতকে বোঝানো হয়েছে। বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে ৩২ বছর আগে আইন করা হলেও এ আইন আদালতের বিচার কাজে আজও কার্যকর হয়নি।
এ অবস্থায় আইন কমিশন সরকারের কাছে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী পৃথক দুটি ঘোষণাপত্র জারির সুপারিশ করে ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি।
কিন্তু সরকার আজও ঘোষণাপত্র জারি করেনি। আইন কমিশন ১৯০৬ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) ১৩৭(২) ধারার আলোকে একটি এবং ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৫৫৮ ধারার আলোকে একটি-এই মোট দুটি ঘোষণাপত্র জারির সুপারিশ করেছিল। কিন্তু গত ১০ বছরেও এ সুপারিশ কার্যকর করেনি সরকার।
২০১৪ সালে দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রচলন আইন অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু দেশের আদালতগুলোতে বিশেষ করে উচ্চ আদালতে মামলার শুনানি ও আদেশ, রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসহ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উচ্চ আদালতে মাতৃভাষায় বিচার কাজ চলে। ওই সব দেশের বিচারপ্রার্থীরা মামলার শুনানি ও রায় সহজেই যাতে বুঝতে পারেন, সেজন্য উচ্চ আদালতের সওয়াল, জবাব, রায় ও আদেশ চলে তাদের নিজেদের ভাষায়। কিন্তু বাংলাদেশে এর বিপরীত।
মন্তব্য