‘মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়- বুকটা হাঁসফাঁস করে’। পরিবারের খরচ, সন্তানদের চাহিদা আর আবদার রক্ষা করতে না পারা নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত অনেক বাবা ও অভিভাবকদের এমন ঘুম ভেঙে যাওয়া পরিস্থিতি। পণ্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে। খরচ সামলাতে না পেরে নিম্নবিত্তদের সঙ্গে নিত্যপণ্য পেতে মধ্যবিত্তরাও যুক্ত হচ্ছে টিসিবির লাইনে।
কয়েক দফায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসারই চলছে না অনেক নিম্নবিত্তের। এই তালিকায় দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে মধ্যবিত্তের লাইনও। পরিচিতদের ভিড়ে মাস্ক দিয়ে নিজেকে আড়ালে রাখছেন তারা। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? এরই মধ্যে অস্থির বাজার দর। নিত্যপণ্য চাল, ডাল থেকে শুরু করে কাঁচাবাজারেও দ্রব্যমূল্য হু হু করে বেড়েই চলেছে। টিসিবির ট্রাকের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও পাওয়া যাচ্ছে না তেলসহ অন্যান্য পণ্য। ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।
দেখা গেছে, ভ্যানচালক থেকে শুরু করে ভালো বেতন পাওয়ারাও আজ জীবন চালাতে চাপের মুখে পড়েছেন। দেখা যায়, করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক ধাক্কায় নতুন করে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে গেছে কয়েক কোটি। এমন পরিস্থিতিতে কোথায় দাঁড়াবে এসব সাধারণ মানুষ।
বলছি, রাজধানীতে বসবাস করা মধ্যবিত্তদের কথা। অবশ্য এ পাল্লায় আগে থেকেই রয়েছে নিম্নমধ্যবিত্তরা। মনে হবে এটি একটি দুর্ভিক্ষজীবনের গল্প। দ্রব্যমূল্যের ঊর্র্ধ্বগতিতে সংসার পরিচালনা করাই কঠিন যাদের কাছে। চাকরির যা বেতন, তাতে চলে না সংসার।
বেসরকারি চাকরিজীবী সৈকত মাহমুদ বলেন, ‘বেতন পান ৩৫ হাজার টাকা। এক ছেলে এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার তাদের। ওদের লেখাপড়ার খরচ আর বাড়িভাড়া দিয়ে আগে ভালোই চলতো সংসার। কিন্তু এখন আর চলে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘মাঝে মাঝে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়, সংসার চালানোর চিন্তায়। মনে হয় আত্মহত্যা করি। কিন্তু সে পথ যে মহাপাপ। দুটি বাচ্চা ও স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে আসি জীবন যুদ্ধে। শুধু এতটুকুই বলি আমাদের মতো শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের জন্য এ শহর না।’
কতটা হতাশাগ্রস্ত হলে একজন পুরুষ এ পথ বেছে নেয়, জানা আছে কারো? এ তো শুধু সৈকত সাহেবের কথা। এমন হাজারো বাবার বুকে প্রতিদিন বেজে চলে অদেখা কষ্টের এই আর্তনাদ।
সরেজমিন রাজধানীর ফার্মগেট, কচুক্ষেত, শাহাজাদপুর, মেরুল বাড্ডা, রামপুরা বাজার ও কাকরাইল এসব এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের এই চিত্র। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা মানুষ। টিসিবির লাইনে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়েছেন তারা। যে কোনো মূল্যেই চাই ন্যায্যমূল্যের মালামাল।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার আনন্দ সিনেমা হলের সামনে দেখা গেছে, ফাঁকা স্থানে শত শত মানুষের ঢল। দুইপাশ দিয়ে গণপরিবহণের চাপ। পুরুষ ও মহিলারা দৌড়ঝাঁপ করে সামনের দিকে যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য একটাই কার সামনে কে লাইনে দাঁড়াবেন।
আগে দাঁড়াতে না পারলে মিলবে না টিসিবির পণ্য। সেজন্য এই মানুষগুলোর এমন অস্থিরতা। গত দুই দিন লাইনের কিছুটা দূরে থাকায় পাইনি সয়াবিন তেল। এর সংখ্যাও কম নয়। আজো হয়নি তার ব্যত্যয়।
গতকাল মঙ্গলবার ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ১২টা। কিন্তু এ দীর্ঘ লাইন শুরু হয় সকাল ৬টা থেকে। সময় যতই গড়িয়ে যায়, ততই দীর্ঘ হয় লাইন। অপেক্ষা, কখন আসবে টিসিবির গাড়ি। গাড়ি আসে দুপুর ১২টায়। কিন্তু এরই মধ্যে দীর্ঘ হয়েছে লাইন। তাতে কেউ পাবে কেউ পাবে না। দৌড়ঝাঁপের এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই বৃদ্ধরাও। আছে সব শ্রেণি পেশার মানুষ।
সৈকতদের মতো হাজারো মধ্যবিত্ত বাবাদের কান্না থেকে যায় অজানায়। সন্তানদের মুখে দুই মুঠো ভাত তুলে দিতে এভাবেই হাজারো বাবা-মা অফিসের ফাঁকে ভর দুপুরে দাঁড়িয়ে থাকছে টিসিবির গাড়ির দীর্ঘ লাইনে। এরপরও খালি হাতে ব্যাগ নিয়ে ফিরতে হচ্ছে অনেককে।
ফার্মগেটে প্যান্টশার্ট পরিধান করা একজন ভদ্রলোককে দেখা গেল খালি ব্যাগ নিয়ে লাইন থেকে ফিরতে। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে প্রথমে নারাজ তিনি। এক সময় মনের কষ্ট ধরে রাখতে না পেরে বলেন কষ্টের কথা। তিনি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের পিয়ন পদে কর্মরত।
তিনি বলেন, ‘আমার বাসা আশপাশেই, আমি সরকারি ছোট পদে চাকরি করি। কিন্তু যা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এভাবে চলা যায় না। বড় মেয়ে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ছেলে দ্বাশম শ্রেণিতে। এবার বোঝেন কি পরিমাণ খরচ হয় ওদের পেছনে।
তিনি আরো বলেন, ‘আশপাশের অনেকেই আমাকে চেনেন। তাই লজ্জায় নিজেকে আড়াল করে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। গতকালও সয়াবিন তেল পাইনি আজো পেলাম না। বাহিরে যে দাম তা কেনা কঠিন। পরিচিত মানুষ দেখলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকি। তারপরও যদি তেল পেতাম।’
মধ্যবাড্ডা প্রগতি সরণি। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা। প্রধান সড়কের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো একটি টিসিবির গাড়ি। তিন যুবক গাড়িতে বসে লাইনে দাঁড়ানো শত শত মানুষকে মালামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে চলছে হইচই। সবার চাওয়া আর কিছু না পেলেও পেতে হবে সয়াবিন তেল।
এদেরই একজন আমেনা বেগম। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি তেল পাননি। তিনি জানান, টানা তিনদিন ধরে লাইনে থেকেও পাচ্ছেন না তেল। লাইন দীর্ঘ হওয়ার কারণে দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
মালামাল না পেয়ে ফিরিয়ে যাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে টিসিবির গাড়ির দায়িত্বে থাকা সাব্বির হোসেন নামের একজন বলেন, ‘এখানে আমাদের কিছু করার নেই। চাহিদা বেশি মালামাল কম। আমরা যে পরিমাণ পাই, তার সবই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মাঝে দিয়ে শেষ করি।
তিনি আরো বলেন, ‘আগে তো নিম্নবিত্তরা আসতেন এখন অনেক ভদ্রলোক আসেন। যারা পরিচিত লোক দেখলে লজ্জা পান। আমাদেরও খারাপ লাগে যখন তারা খালি হাতে ফিরে যান। লাইন দীর্ঘ হওয়ার কারণে আর তেল পর্যাপ্ত না থাকাই এটা হচ্ছে।
মন্তব্য