প্রতিবছর রমজান মাস আসলেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যে বাজারে বেড়েছে প্রায় সবধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম। ফলে করোনা মহামারিতে
ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ হাফিয়ে ওঠেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীল হলেও রমজানকে সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্যের
মজুত রয়েছে। কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। কোনো অসাধু চক্র বাজার মূল্য অস্বাভাবিক করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে সরকার। মূলত রমজান কেন্দ্রিক পেঁয়াজ,
ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম), পরিশোধিত চিনি, মশুর ডাল, ছোলা এবং খেজুরের চাহিদা বেশি থাকে। সরকার এবছর রমজান উপলক্ষে ১ কোটি পরিবারকে (প্রায় ৫ কোটি জন) এসব পণ্য স্বল্পমূল্যে
টিসিবির মাধ্যমে সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েছে। যা বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকারের আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা থেকে সুনিদিষ্ট ৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। যা বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করবে
বলে ব্যবসায়ী এবং সরকার পক্ষ একমত হয়েছে।
সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি বলেছেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুত রয়েছে, কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। কোনো অসাধু ব্যবসায়ীকে সুযোগ নিতে দেয়া হবে
না। দেশব্যাপী প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কৃত্তিম উপায়ে পণ্যের সংকট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হলে বা পণ্য অবৈধ মজুত করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আন্ত:মন্ত্রণালয় সভায় রমজান উপলক্ষে পণ্যের মজুদ, সরবরাহ, আমদানি, মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ২ মার্চ বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সভাটি
অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
অন্যদিকে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, এখন বাজারে যে পরিস্থিতি তার জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। আমদানি
ভোগ্যপণ্যের খালাসে যেন কোনো জট তৈরি না হয়। পরবর্তীতে দেশের সব অঞ্চলে সময়মতো পণ্য পৌঁছানো বিষয়কে প্রশাসনকে সচেতন এবং সহযোগিতা করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে উৎসব কেন্দ্রিক
চাঁদাবাজি শুরু হয়। এটি বন্ধ করতে হবে। এছাড়া স্বাভাবিক থেকে অতিরিক্ত মজুদ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে অভিযান চালাতে হবে।
রমজানকে সামনে রেখে মন্ত্রণালয়ের সভায় যে ৬ সুপারিশ করা হয়েছে : সমুদ্র ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং শুল্ক স্টেশনসমূহ পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাসে সর্বোচ্চ
অগ্রাধিকার প্রদান, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে ফেরি পারাপারে বিআইডব্লিউটিসির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ অগ্রাধিকার
ভিত্তিতে সহায়তা প্রদান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন টিসিবি’র কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতা করবে, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও মজুদকারীর বিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বৃদ্ধির সুপারিশ এসেছে।
রমজানকে সামনে রেখে সরকার পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম), পরিশোধিত চিনি, মশুর ডাল, ছোলা ও খেজুরের মজুদ নিশ্চিত করেছে বলে জানা গেছে।
পেঁয়াজ : দেশে প্রায় ২৫ লক্ষ মেট্রিক টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে, এর মধ্যে রমজানের চাহিদা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লক্ষ মেট্রিক টন। স্থানীয় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ দশমিক ০৪ লক্ষ মেট্রিক টন। এর মধ্যে
সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার সমস্যার কারণে নষ্ট হচ্ছে ১০ লাখ মেট্রিক টন বা প্রায় ২৫ শতাংশ। আমদানি হচ্ছে প্রায় ৬ থেকে ৭ লক্ষ মেট্রিক টন। সংরক্ষণের অভাবে আমদানি পেঁয়াজে প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষতি হচ্ছে (নষ্ট) ৮ থেকে ১০ শতাংশ।
ভোজ্যতেল : দেশে প্রায় ২০ লক্ষ মেট্রিক টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজানের চাহিদা ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ লক্ষ মেট্রিক টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয় ২ দশমিক ০৩ লক্ষ মেট্রিক
টন। আমদানি প্রায় ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন। অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি প্রায় ৫ লক্ষ মেট্রিক টন। সয়াবিন বীজের আমদানি প্রায় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন (যা থেকে ৪ লক্ষ মেট্রিক টন অপরিশোধিত
তেল হয়)। অপরিশোধিত পাম অলিনের আমদানি প্রায় ১১ লক্ষ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছর (২০২১-২০২২) অপরিশোধিত তেল আমদানিতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত আছে।
মশুর ডাল : দেশে প্রায় ১ লক্ষ মেট্রিক টন মশুর ছোলার চাহিদা রয়েছে। রমজানে চাহিদা ৮০ হাজার মেট্রিক টন। স্থানীয় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬ হাজার মেট্রিক টন। বাৎসরিক আমদানি প্রায় ১ লক্ষ
মেট্রিক টন। ছোলা আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই।
চিনি : দেশে প্রায় ১৮ লক্ষ মেট্রিক টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে, রমজানের চাহিদা ৩ লক্ষ মেট্রিক টন
আখ থেকে চিনির স্থানীয় উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন। আমদানি প্রায় ১৯ লক্ষ মেট্রিক টন। অপরিশোধিত চিনি পরিশোধন কালে ৬ দশমিক ৫ প্রসেস লস (প্রক্রিয়াজাত ক্ষতি) হয়।
অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে বিভিন্ন হারে প্রায় ৬১ শতাংশ শুল্ক আরোপ রয়েছে।
ছোলা : দেশে প্রায় ১ লক্ষ মেট্রিক টন মশুর ছোলার চাহিদা রয়েছে। রমজানে চাহিদা ৮০ হাজার মেট্রিক টন। স্থানীয় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬ হাজার মেট্রিক টন। বাৎসরিক আমদানি প্রায় ১ লক্ষ মেট্রিক
টন। ছোলা আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই।
খেজুর : দেশে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। রমজানে চাহিদা ২৫ হাজার মেট্রিক টন। বাৎসরিক আমদানি প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। খেজুর আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই।
এদিকে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, এখন বাজারে যে পরিস্থিতি তার জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে
উৎসব কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি শুরু হয়। এটি বন্ধ করতে হবে। এছাড়া স্বাভাবিক থেকে অতিরিক্ত মজুদ বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, বাজার পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে ওঠার জন্য ভোক্তার অভ্যাসের কারণ রয়েছে। অনেকে দাম বাড়ার গুজবে অতিরিক্ত পণ্য কিনে থাকেন। এই অভ্যাস পরিবর্তন হলে বাজারে চাপ কমবে
এবং বাজার দর স্বাভাবিক থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজার অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়। এজন্য ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজার দরের ক্ষেত্রে সরকারের
কিছু করার থাকে না।
রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকারের টিসিবি কার্যক্রম ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এবারের রমজান উপলক্ষে ১ কোটি পরিবারকে
স্বল্পমূল্যে (পেঁয়াজ, তেল, ডাল, ছোলা, চিনি ও খেজুর) সরবরাহ করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে বাজার কিছুটা স্বাভাবিক হবে বলে আমি মনে করি।
মন্তব্য