-->
শিরোনাম

দেশে ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে নৌপথ

* স্বাধীনতার ৫০ বছরে নৌপথের পরিমাণ কমেছে প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার * যাত্রী নেমেছে ৮ শতাংশের নিচে * প্রবাহ না থাকায় বিলীন হয়ে গেছে বহু নদী

শাহীন রহমান
দেশে ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে নৌপথ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি বা প্রবাহ না থাকায় বিলীন হওয়ার পথে দেশের এক-তৃতীয়াংশ নদী।

যাতায়াত ও পণ্য পরিবহণের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ ও ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশে নৌপথের গুরুত্ব রয়েছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। অথচ বদলে যাওয়ার কাতারে যোগ হয়েছে নৌপথও। দিন দিন গুরুত্ব কমছে নৌপথের। বিগত পাঁচ দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ। সেইসঙ্গে নৌপথে যাত্রী পরিবহণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশের নিচে। একইসঙ্গে প্রবাহ না থাকায় চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে বহু নদী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ অনেক বদলে গেছে। তবে নৌপরিবহণ সেক্টরের রয়েছে সমৃদ্ধির ইতিহাস। গুণগতমান উন্নয়ন এবং নিরাপদ-নির্বিঘ্নে নৌচলাচল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রশংসনীয় ভূমিকা যেমন রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে প্রতিনিয়ত দখল, ভরাট, দূষণ, দুর্নীতি, দুর্ঘটনা, অপরিণামদর্শী উন্নয়ন বা অপরিকল্পিত নগরায়ণ-শিল্পায়নসহ মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের শিকার হয়ে নদী ও নৌপথের করুণ চিত্র।

পরিবেশ ও নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, ‘উন্নত ও আধুনিক যাতায়াতের নামে সড়কপথের প্রতি অধিক মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে নৌপথ উপেক্ষার শিকার হয়েছে ব্যাপকহারে। উপকূলীয় জেলাগুলোয় নৌপথ প্রধান ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড হিসেবে এর প্রসার ঘটলেও নদীতীরবর্তী এলাকা এবং হাওড় অঞ্চলে তেমন প্রসার ঘটেনি।’

আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থা আইইউসিএন ও বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৫ সালে দেশের মোট যাত্রীর ৫৪ শতাংশ সড়কপথে, ৩০ শতাংশ রেলপথে এবং ১৬ শতাংশ অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাতায়াত করত। ১৯৯৬ সালেও হিসাবেও নৌপথে মোট যাত্রীর ১৫ শতাংশ যাতায়াত করত। ২০০৫ সালে একটি কমে মাত্র ৮ শতাংশ নিচে নেমে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে অনেক নদীর পানি কমে যাওয়া, নদী-খাল দখল হয়ে যাওয়া, ভারত থেকে পানিপ্রবাহ প্রত্যাহার করা, নদনদী ও খাল খনন না করা এবং বাজেটে এ খাতে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ কম হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে তারা উল্লেখ করেছেন, বিগত পাঁচ দশকে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের মধ্য থেকে উধাও হয়ে গেছে ১৮ হাজার কিলোমিটারের বেশি। এখন বর্ষায় প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার নৌপথের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও শুষ্ক মৌসুমে তা কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটারে।

নদীমাতৃক এদেশে একসময় জালের মতো বিছিয়ে ছিল নদী। তবে জালের মতো বিছিয়ে থাকা এদেশে নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে এখনো গরমিল রয়েছে। তবে সংখ্যা নিয়ে গরমিল থাকলেও অধিকাংশ নদীই যে হুমকির মুখে, এ বিষয়ে কারোর মধ্যেই দ্বিমত নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি বা প্রবাহ না থাকায় বিলীন হওয়ার পথে দেশের এক-তৃতীয়াংশ নদী। বর্ষাকালে প্রবহমান থাকা অর্ধেকের বেশি নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। সারা বছরই চলে চাষাবাদ। বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে এগুলোকে আর নদী বলে মনে হয় না। আবার অনেক নদী বিলুপ্ত হয়ে কালের সাক্ষী হয়ে গেছে। মৃত্যুর প্রহরও গুনছে অনেক নদী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী মৃত্যুর পেছনে যেমন প্রাকৃতিক কিছু কারণ রয়েছে। পাশাপাশি মানুষের কারণে এসব নদী আজ অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। ফারাক্কা বাঁধ এবং তিস্তা ব্যারাজ এবং উজানে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার অনেক নদীর মৃত্যু ঘটছে। প্রতি বছর বর্ষায় বিলিয়ন টন পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণেও ভরাট হয়ে প্রবাহশূন্য হয়ে পড়ছে নদীগুলো।

স্বাধীনতার পর গত তিন দশকের বেশি সময়ে নদীগুলো বেশি করুণ অবস্থার শিকার হয়েছে। তবে মূলত ফারাক্কা বাঁধের কারণেই নদীগুলো এত তাড়াতাড়ি মরতে বসেছে। এছাড়া নদীতে প্রতি বছর এত পরিমাণ পলি জমছে, তা পানির অভাবে বহন করে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ১২৫ কিলোমিটারের তিস্তার অববাহিকায় নদীভিত্তিক জীবনযাত্রা ও জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের সম্মুখীন।

মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় সেচ এ প্রকল্পের। এর আওতাধীন ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর বোরো চাষের জন্য শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না। তিস্তায় পানি না থাকায় এ অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, অখিরা, দুধকুমার বুড়িতিস্তাসহ ছোট বড় প্রায় ৩৩টি নদী ভরাট হয়ে গেছে।

মন্তব্য

Beta version