১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি এই নির্দেশ বাস্তবায়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে তিন মাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার আদেশ থাকলেও তা পালন করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ কারণে সরকারের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছেন রিট আবেদনকারী ড. বশির আহমেদ। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কখন, কীভাবে, কোন স্তরে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হবে তা ঠিক করতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশনা ছিল। শিক্ষা সচিবের প্রতি এই নির্দেশনা ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন দাখিল করেনি সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
তিনি বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার ইতিহাসের জন্য মাইলফলক। অথচ এই ভাষণ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তিতে সরকারের কতিপয় কর্মকর্তার অনীহা চোখে পড়ছে। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা ছাড়া কোনো পথ দেখছি না।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার ভোরের আকাশকে বলেন, হাইাকোর্ট রায় দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি আমার জানা নেই।
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান (বর্তমানে মৃত) ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বছর ৮ সেপ্টেম্বর এক রায়ে ৭ই মার্চ দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে বলা হয়। কমিটিতে কারা থাকবেন, তাদের তালিকা দাখিল করতে বলা হয়।
রায়ে বলা হয়, কোন পর্যায়ে, কোন ক্যাটাগরিতে, স্কুল, কলেজ না আরো উপরে- এটা (ভাষণ) অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ধারণ করে দেবে ওই কমিটি। এ সংক্রান্ত রুল নিষ্পত্তি করে রায় দেন হাইকোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ড. বশির আহমেদের করা এক রিট আবেদনে এ রায় দেওয়া হয়। ওই সময় আদালতে রিট আবেদনকারী নিজেই শুনানি করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
জানা গেছে, ওই রায় ঘোষণা পর্যন্তই সব রয়ে গেছে। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। এ কারণেই রিট আবেদনকারী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
এর আগে হাইকোর্ট ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এক মাসের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ এরইমধ্যে কার্যকর করেছে সরকার। এছাড়া মুজিব বর্ষের মধ্যেই দেশের সকল জেলা-উপজেলা কমপ্লেক্সে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের নির্দেশ দেন আদালত। এ নির্দেশও বাস্তবায়ন হয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ওই দিনটি জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে ২০১৭ সালে রিট আবেদন করেন ড. বশির আহমেদ। এ রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর রুল জারি করেন।
রুলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন এবং স্বাধীনতার পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল সেই মঞ্চ কেন পুনর্নির্মাণ, বঙ্গবন্ধুর আঙুল উঁচানো ভাস্কর্য স্থাপন ও ৭ই মার্চ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে কেন ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।
এই রুলের ওপর শুনানিকালে ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক আদেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন সেই মঞ্চ পুনর্নির্মাণ, বঙ্গবন্ধুর আঙুল উঁচানো ভাস্কর্য স্থাপনের প্রকল্প পরিকল্পনা (প্রজেক্ট প্ল্যান) গ্রহণ এবং ৭ই মার্চ দিনটিকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে ঘোষণার বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পক্ষ থেকে দাখিল প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ই মার্চের ভাষণস্থলে থাকা শিশুপার্ক ও মন্দিরের কমপ্লেক্সসহ সব স্থাপনা অপসারণের কাজ চলছে। এরপর এক সম্পূরক আবেদনে গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট পৃথক এক আদেশে পাঠ্যপুস্তকে ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত প্রশ্নে রুল জারি করেন। আগে ও পরে জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে তা নিষ্পত্তি করে রায় দেন হাইকোর্ট।
মন্তব্য