পরাধীনতা থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি জনগণ ও শাসকশ্রেণির নাড়ি বুঝতেন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে আসা বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য ভাষণ, বক্তৃতা, সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। ফলে জনগণের সাথে তার যোগাযোগের ক্ষমতা ছিল অনবদ্য।
সহজ-সাবলীলভাবে তার কথাগুলো জনগণকে বুঝিয়ে দিতে পারতেন। আর ১ মার্চ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার পর তিনি ও তার দলের নেতা-কর্মীরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন ৭ তারিখের ভাষণের ব্যাপারে। বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে ডেকে বলেন, ‘আমি তো লিখিত বক্তব্য দেব না; আমি আমার মতো করে দেব। তুমি পয়েন্টগুলো ফরমুলেট কর।’ আর ড. কামালের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সাথেও কয়েকবার বৈঠক করেন। ছাত্রনেতাদের সাথেও বৈঠক হয়। তারা বঙ্গবন্ধুকে বলেন, সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে। বঙ্গবন্ধু সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। মঞ্চে উঠে চিরাচরিত ভঙ্গিতে সম্বোধনের মাধ্যমে শুরু করেন তার বক্তৃতা। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি মোট ১১০৮টি শব্দ উচ্চারণ করেন। মিনিটে গড়ে ৪৮ থেকে ৫০টি শব্দ বের হয় তার মুখ দিয়ে। বঙ্গবন্ধু মাটি ও মানুষের নেতা। তাই, তার ভাষণেও মাটি ও মানুষের ভাষা লক্ষ করা যায়।
প্রমিত বাংলায় প্রদত্ত সে ভাষণে তিনি তুলে ধরেন শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস, সমসাময়িক হত্যাকাণ্ডের কথা, রাজনৈতিক দোলাচল এবং বাংলার মানুষের স্বায়ত্তশাসন লাভের বাসনাটি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি অলিখিত হলেও ভাষণের মাঝে তালপতন বা পুনরাবৃত্তির কোনো ঘটনা লক্ষ করা যায়নি। শব্দ চয়নের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন যথেষ্ট মার্জিত ও ধৈর্যশীল। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোকে তিনি সম্বোধন করেন ‘জনাব এহিয়া খান সাহেব’, ‘জনাব ভুট্টো সাহেব’ বলে।
ভাষণে এমনভাবে শব্দ প্রয়োগ করেননি যাতে মনে হতে পারে তিনি সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রাম বা আন্দোলনকে উস্কে দিচ্ছেন। ৭ মার্চের ভাষণের শাব্দিক গুরুত্ববহতার আরেকটি দিক হচ্ছে ভাষণটিতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রবাহ অনুসারে কথাগুলো বলা হয়েছে। প্রথমদিকে ইতিহাস, মাঝের দিকে অত্যাচার ও অন্যায়ের কথা এবং হুশিয়ারির সাথে সাথে আলোচনার আহ্বান আর শেষের দিকে জনগণের প্রতি দিক-নির্দেশনামূলক কথাবার্তা।
শেষের কথাটি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডায়লগ যেটি শোনার জন্যেই শ্রোতারা মুখিয়ে ছিলেন। সবশেষে ‘জয় বাংলা’ বলে ভাষণটি শেষ করেছেন বঙ্গবন্ধু, যে স্লোগানটি পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল।
৭ই মার্চে রেসকোর্সের ভাষণের পর নিউইয়র্কের দ্য নিউজউইক ম্যাগাজিন ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করে। আর ১৯৭০ সালে পাস্তিানের প্রথম জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে জয়ী হয়ে ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
কিন্তু পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অস্বীকৃতি জানালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে যেতে থাকে। হঠাৎ ১ মার্চ আকস্মিকভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া সমগ্র জাতিকে স্তম্ভিত করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
বাংলার মানুষ তীব্রক্ষোভ ও আক্রোশে ফেটে পড়ে। তারা অপেক্ষা করতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের দীপ্ত ঘোষণার জন্য।
সকলের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ গর্জে ওঠে ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রের সামনে। আর ২০১৭ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বার্তা ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্বীকৃতি পেয়েছে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে।
★ ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব : এ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্ব ইতিহাসে নতুন এক শিখড়ে পৌঁছে যায়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতা ও গেরিলাযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা। এর পরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ বজ্র নিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আনন্দে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাক্সিক্ষত মুক্তির লক্ষ্যে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনার পথ ধরেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বিশ্বমানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব নিচে তুলে ধরা হলো :
১. গণতন্ত্রের ডাক : বঙ্গবন্ধু তার ১০৯৫ তথা ১১০৮ শব্দের ভাষণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং দেশের শাসনতন্ত্র তৈরির আকুল আবেদন ও তীব্র আকাক্সক্ষা পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলব’। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার এ ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম।
২. বৈষম্যের ইতিহাস উপস্থাপন : বঙ্গবন্ধু ভাষণের প্রথম পাকিস্তান আমলের দীর্ঘ তেইশ বছরের বৈষম্যমূলক ইতিহাস তুলে ধরেন। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ ও শাসন করতে থাকে, গড়ে ওঠে বৈষম্যের পাহাড়। সামরিক বাহিনীর তিনটি সদর দপ্তরই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনীতে ৯৫ ভাগই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি, অর্থনৈতি ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ছিল আরো ব্যাপক। ব্যাংক, বিমা, বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি, বিদেশি মিশনসমূহের হেড অফিস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ফলে অবাধে অর্থ পাচার সহজ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। অথচ কৃষক ন্যায্য মূল্য পেত না। শিল্প কালকারখানা অধিকাংশ হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। ফলে পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আচরণ ছিল বিমাতাসুলভ। পূর্ব বাংলার জননেতা আবুল কাশেম ফজলুল হকসহ জনপ্রিয় নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় রাখার চেষ্টা করা হয়। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তানন্তরে গড়িমসি আরম্ভ করে। ফলে জনগণ এসব বৈষম্যের প্রতিবাদে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধিকারের দাবি তোলে। আর তখনই পাক-গোষ্ঠীর অস্ত্রের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠে নিরীহ জনগণের ওপর।
৩. নির্যাতনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র : বঙ্গবন্ধুর ভাষণে বাঙালি জাতির ওপর দীর্ঘ তেইশ বছরে যে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে তার চিত্র ফুটে উঠেছে। জাতির জনক তার ভাষণের তৃতীয় লাইনেই বলেন কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম রাজশাহী রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে- তিনি ভাষণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ২৩ বছরের শাসনামলকে বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন ‘২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস’। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পাক বাহিনী রক্ত ঝরিয়েছে। পশ্চিমা গোষ্ঠী চেয়েছে হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষকে দমন করে রাখতে।
৪. সংগ্রামী চেতনার ডাক : স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিতে বাঙালি জাতি যে সংগ্রামের সূচনা করে আত্মাহুতি দেয় বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে তা তুলে ধরেছেন। নানাদিক থেকে বঞ্চিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত জনগণ তাদের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আন্দোলন চালাতে থাকে। মৃত্যুর মুখেও নির্ভয়ে এগিয়ে যায় এবং রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। দেশকে মুক্ত করার জন্য জনগণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালালেও পাক সামরিক বাহিনী গুলি চালায় নিরীহ জনগণের ওপর। তবুও সংগ্রামী জনগণ পিছপা হয়নি।
৫. বাঙালি জাতীয়তাবাদ : বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি সবার কথাই বলেছেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো নেতা করতে পারেনি। তিন সেদিন সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে একতার জলন্ত শিখার বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন তার সম্মোহনী বক্তব্যের মাধ্যমে, যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল।
৬. বাঙালির ঐক্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জনগণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ঐক্যবদ্ধ জনগণকে দেখেই বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। দেশকে মুক্ত করার জন্য সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৭. নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য : সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় আশা প্রকাশ করে, তারা তার আহ্বানে সাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জগণণ রাস্তায় নেমে আসে। গড়ে তোলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
৮. অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি : বঙ্গবন্ধু সেদিন তার ১৯ মিনিটের ভাষণে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির অভিপ্রায় আবেগাপ্লুত অথচ বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রকাশ করেন। তিনি দারিদ্র্য মুক্ত, ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং মাতৃভাষায় নির্বিঘ্নেন কথা বলতে পারে এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে’।
৯. প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা : বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রশাসনিক গুরুত্বও অপরিসীম। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক’।
১০. গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশনা : তিনি অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণকে প্রতিহত করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে যে কৌশল প্রয়োগের নির্দেশনার দিয়েছেন তা, খুবইগুরুত্ববহ। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে, রাস্তাঘাট যা যা আছে আমি যদি হুকুম দেবার না পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে, আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’।
১১. মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণা : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে এই বলে মুক্তির সংগ্রাম ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার এই নিষ্কম্প ঘোষণা বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা দিয়েছিল। জাতির উদ্দেশ্যে এই ছিল তার যুদ্ধপূর্ব শেষ ভাষণ। তাই এতে তিনি যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রস্তুতির কথা বলেছিলেন। তখন বাঙালির হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। তাই যার যা আছে তা নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তার এই সংগ্রাম ঘোষণায় যে পশ্চিমাদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাবে তা তিনি ধারণা করেছিলেন। সেজন্য তৎকালীন হানাদার শাসকদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা প্রদর্শনের নির্দেশ দেন। তিনি তার অনন্য ভাষণে মুক্তিসংগ্রামের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন।
১২. চার দাবি : বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে সুস্পষ্টভাবে চারটি দাবি পেশ করেন, যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এর গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ তার এই দাবিগুলো তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ না দিতে পারে তার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তার দাবিগুলো ছিল (১) সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে (২) সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে (৩) যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে এবং (৪) জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
পরিশেষে ইউনেস্কো এ ভাষণকে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার এর মাধুর্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব এবং বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাস এখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে-ছড়িয়ে বহু-ভাষী মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এটি এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং সারাবিশ্বের সম্পদে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব সংস্থার স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গবেষণা হবে, বিশেষ করে জ্ঞানান্বেষী তরুণ সমাজের মনে এটি স্থান পাবে। যুগে যুগে এই ভাষণ বাঙালির আত্মচেতনা-জাগরণের শক্তি হয়েই থাকবে, যতদিন বাংলাদেশ আর বাঙালি রবে এ পৃথিবীতে, তত দিন লাল-সবুজের পতাকা উড়বে বিশ্বজুড়ে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
মন্তব্য