সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও জুলফিকার আলি ভুট্টো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, সংবিধান ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হবে এবং কেউই তা প্রতিহত করতে পারবে না। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, আওয়ামী লীগ সমগ্র দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল- দেশে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থাকতে পারে না এবং প্রতিনিধিত্বশীল পদ্ধতির নিয়মানুসারে তার দল কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব নিয়ে ভূমিকা পালন করবে। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু আলোচনার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ইয়াহিয়া খান ১৪ জানুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৭ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাড়িতে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। ভুট্টো গণপরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশন বয়কট করার ঘোষণা দেন। এভাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে।
জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলি ভুট্টোর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এক ঘোষণা জারির মাধ্যমে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ঘোষণাটির সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ সারা বাংলায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। এরপর পূর্ববাংলার শাসন মূলত চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় যেমন বাঙালিদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল, একইভাবে ১ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা বাঙালিদের স্তম্ভিত করে দেয় এবং রাজনৈতিক অবিশ্বাসটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলি লিখেছেন, ‘অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলা যেতে পারে পাকিস্তান ভেঙে গেল।’
বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতালের ডাক দেন। ২ মার্চ সবুজের মধ্যে লাল বৃত্তসংবলিত বাংলাদেশের মানচিত্র উত্তোলন করেন। ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে স্বাধীনতার ঘোষণা, ইশতেহার ও প্রস্তাব পাঠ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ জনসভায় উপস্থিত ছিলেন। হরতাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু হয়। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার প্রতি সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করে এবং আওয়ামী লীগের মিছিলে গুলি চালায়। ফলে ৩ মার্চকে শোক দিবস ঘোষণা করা হয়।
ইয়াহিয়া খান ইতোমধ্যে ৬ মার্চ রাতে দেশবাসীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫ মার্চ আহ্বানের ঘোষণা দেন। তিনি বেলুচিস্তানের ‘কসাই’ হিসেবে পরিচিত টিক্কা খানকে নিয়োগ দেন। উদ্দেশ্য ছিল- পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে যাতে কঠোর হস্তে দমন করা যায়। ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ এবং ৭ মার্চ টিক্কা খানকে ঢাকায় প্রেরণ ছিল ইয়াহিয়া খানের দুরভিসন্ধির পরিচায়ক। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পূর্বঘোষিত ৭ মার্চের জনসভায় প্রভাব ফেলার বন্দোবস্ত করতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া।
এরই অংশ হিসেবে ৬ মার্চ ঢাকা, টঙ্গী ও রাজশাহীতে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়; যা বাঙালিদের আরো ক্ষিপ্ত করে তোলে। এরূপ পরিস্থিতিতে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও দিকনির্দেশনার জন্য বাঙালিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কিছু ব্রিটিশ পত্রিকা পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণার সম্ভাবনার কথা বলে। বঙ্গবন্ধু হয়তো একতরফা স্বাধীনতা বা পূর্ণ স্বাধীনতার মতো কিছু প্রস্তাব অথবা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ২৫ মার্চের অধিবেশন আহ্বানের সঙ্গে একমত হতে পারেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ প্রদত্ত ভাষণে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর এ উচ্চারণ একতরফা স্বাধীনতার মতোও নয়, আবার পূর্ণ স্বাধীনতা থেকেও কোনো অংশে কম ছিল না।
মার্চের ৮ ও ৯ তারিখ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কিছু নির্দেশনা আসে। সরকারি ও বেসরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং কোর্টে হরতাল পালনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। বাঙালি ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ মোতাবেক ৮ মার্চের নির্দেশনায় ব্যাংকের প্রতি আলাদা নির্দেশ জারি করা হয়। ১১ মার্চের দিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখার জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম ও কিছু ফার্মের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে প্রায় ১৬টির মতো নির্দেশনা প্রদান করা হয়। আন্দোলনের এ পর্যায়ে পূর্ববাংলার সম্পূর্ণ প্রশাসন অর্থাৎ অফিস, আদালত, ব্যাংক, বিমা, কলকারখানা, পরিবহণ, সমুদ্রবন্দর, ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেতার, টেলিভিশন সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সব খুলেছে, তার নির্দেশেই বন্ধ হয়েছে।
১৫ মার্চের নির্দেশানুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি অফিসকে আগের মতো হরতাল পালনের কথা বলা হয়। তবে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইপিআরটিসির বাস চালু এবং রেলওয়ে চালু থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। ১৫ মার্চ প্রদত্ত ওই ৩৫টি নির্দেশনা বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকরাও প্রশংসা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সকে দেওয়া চিঠিতে মার্কিন কূটনীতিক জোসেফ সিসকো নির্দেশনাগুলোকে ‘সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত’ পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন।
সংকট সমাধানের জন্য প্রেসিডেন্ট আন্তরিক- এ ধরনের মনোবৃত্তি প্রদর্শনের উদ্দেশে ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে পৌঁছান। ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী আলোচনার অন্তরালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার কাজও চালিয়ে যায়। আমেরিকার একটি রিপোর্টে দেখা যায়, ৪ মার্চে পাকিস্তানি বাণিজ্যিক এয়ারলাইনস এবং জাহাজের মাধ্যমে অনেক সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ব্রিটিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, মধ্য মার্চ থেকে ঢাকায় প্রায় ১৫ হাজার সৈন্য প্রেরিত হয়। সাগরপথে জাহাজে করে সৈন্য, ট্যাংক ও গোলাবারুদ আনার বিষয়েও রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়।
২ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার বাণিজ্যিক ফ্লাইট প্রায় ১২ হাজার সেনা বহন করে আনে বলে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ১৫-২৫ মার্চে পর্যন্ত চলা আলোচনাকে ‘আধুনিককালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক হেঁয়ালির নাট্যমঞ্চ’ বলে অভিহিত করেছেন অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। ২২ মার্চ পূর্বঘোষিত ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন পুনরায় স্থগিত করা হলে পূর্ববাংলার জনগণ ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে। ওইদিন বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র খালাস করার কথা ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ বন্দর এলাকা ঘেরাও করে। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর নীলনকশা আরো স্পষ্ট হয়। ২৫ মার্চে শুরু হওয়া ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে বাঙালি নিধনের যে সূত্রপাত হয়, তা পরবর্তী ৯ মাস অব্যাহত থাকে।
লেখক : শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য