-->
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

জুনায়েদ হোসাইন
মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে টিসিবির ট্রাক সেলের সামনে মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের উপস্থিতি বেড়েছে বেশ। ছবি- ভোরের আকাশ

করোনা মহামারি সংক্রমণ কমে আসলেও দেশের বাজারে হুহু করে বাড়ছে নিত্যপণ্য ও আনুষঙ্গিক সব রকমের পণ্যের দাম। এর মধ্যে তেল নিয়ে তেলেসমতি শুরু হয়েছে। ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানো হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির নতুন ইস্যু যুক্ত হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যদিও বিশ্লেকরা বলছেন, যুদ্ধ শুরুর আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যের কাঁচামাল এবং আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রভাব পড়ছে। এদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার, শবেবরাত ও পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে একটি অসাধু চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অনৈতিকভাবে পণ্য মজুদ করে বাজারে সংকট তৈরি করছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এর প্রতিকারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও আমদানকারকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে নীতিনির্ধারণী মহল। এর মধ্যেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না, দ্রব্যমূলের লাগাম। ফলে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাভিশ্বাস উঠেছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বাজারে সবজি থেকে শুরু করে, স্বর্ণ ও নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। নিত্যপণ্যের মধ্যে সবজির দাম গেল শীতও গরম ছিল। প্রতিবছর যে টমেটো শীতকালে বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকায় তা’ এ বছর ৪০ টাকার নিচে দাম আসেনি। এছাড়া শিম, কপি, শাকসবজিসহ অন্যান্য মৌসুমি পণ্যের দামছিল ঊধ্বমুখী।

এছাড়া, পরিবারের ব্যবহৃত আনুষঙ্গিক পণ্য তথা প্রসাধনী, সকাল বা বিকেলের নাশতার বেকারি পণ্য এবং আসবাবপত্রের দাম বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া, বিদেশি পণ্যের দাম ১০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। এছাড়া শিশুখাদ্য গুঁড়া দুধের দামও বেড়েছে অনেক। এই সময়ে বেড়েছে, সুগন্ধি ও কাপড় কাচার সাবান ও গুঁড়া সাবানের দাম। এক কথায় বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। কয়েকদিন আগে এক লাফে মানভেদে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম দুই থেকে সোয়া ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণে ৭৮ হাজার ২৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে টনপ্রতি রডের দাম বেড়েছে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এক টন রডের দাম ৮৬ থেকে ৮৮ হাজার টাকায় পৌঁছেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া প্রতি ব্যাগ (৫০ কেজি) সিসেন্টের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে।

চলমান পরিস্থিতির বিষিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার আইনজীবী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলম শিপন ভোরের আকাশের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তিনি জানান, পণ্যের বাজার পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, শুধু সাধারণ মানুষ কেন, মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি চিন্তায় পড়েছে।

হেলাল উদ্দিন নামের একজন উদ্যোক্তা ৪০, ৪৫ জন পাইকার নিয়ে তৈরি পোশাকের ব্যবসা করেন। গত কয়েকদিন আগে বার্ষিক হিসাব বা হালখাতার আয়োজন করেন তিনি। করোনার আগে এই আয়োজন বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো হলেও এবার ব্যতিক্রম। পাইকার তার বকেয়া দিতে না পেরে অনুষ্ঠানে আসেননি। আবার যারা এসেছেন, তারাও হিসাব শেষ করতে পারেননি। এতে ব্যবসায়িক লোকসানে পড়েছেন ওই ব্যবসায়ী।

মো. জুয়েল নামের অন্য একজন ঢাকার বনশ্রী এলাকার ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও ৬ বছরের কন্যা সন্তান নিয়ে থাকেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির কারণে মাস শেষ বেতনের অপেক্ষায় থাকেন তিনি। এর মধ্যে বাকির দোকান থেকে নিত্য ও আনুষঙ্গিক পণ্য নিয়ে থাকেন। বেতন হাতে এলেই হিসাব করে দেনা পরিশোধ করেন তিনি। ফেব্রুয়ারি মাস বিদায় নিলেও বেতন হাতে পাননি জুয়েল। তবে এর মধ্যেই, দোকানি জানিয়েছেন, আগের মাসের থেকে সব খরচে বেড়েছে। গতকাল (বুধবার) মোবাইল ফোনে আলাপকালে তিনি এমনটি জানিয়েছেন।

জুয়েল জানান, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে বাড়ির মালিকরা বাসাভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন। অন্যদিকে মেয়ের স্কুল শুরু হচ্ছে, এতে যাতায়াত খরচ যোগ হবে। সব মিলিয়ে চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ার উপক্রম হয়েছে তার।

সম্প্রতি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করোনায় থাবায় কমপক্ষে আড়াই কোটি মানুষ বেকার হয়েছে। এর মধ্যে এখনো বেশিরভাগ মানুষ চাকরি পাননি। হাতে থাকা জমানো টাকা অথবা সম্পদ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন তারা। যাদের একটা বড় অংশই মধ্যবিত্ত।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে টিসিবির ট্রাক সেলের সামনে মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের উপস্থিতি বেড়েছে বেশ। পরিস্থিতির কারণে এখন আর কেউ মুখ লুকাতে চান না। বেঁচে থাকাটাই সবার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের আকাশকে বলেন, সারা পৃথিবীতেই পণ্যের চড়া মূল্য। আগামী ছয় মাসে এ পরিস্থিতি স্বভাবিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। জ্বালানি তেলের বাজারও অস্থির হয়ে উঠেছে। ফলে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কিছু করার থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। খুব খারাপ অবস্থা। এক্ষেত্রে ভোক্তাদের জন্য বলব, একটু সংযোমী হতে হবে। যেখানে না গেলে সমস্যা হবে না, তা এড়িয়ে চলা। জ্বালানি সাশ্রয়ী হওয়া। ভোজ্যতেল ও অন্যান্য বিলাশ পণ্যের ব্যবহার কমানো। প্রয়োজনের তুলনায় একটু সাশ্রয়ী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

এদিকে আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের বাজার সাভাবিক রাখতে সরকারের আন্তমন্ত্রণালয় সভা থেকে সুনির্দিষ্ট ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। যা বাজার পরিস্থিতি সাভাবিক রাখতে সহায়তা করবে বলে ব্যবসায়ী এবং সরকার পক্ষ একমত হয়েছে।

মন্তব্য

Beta version