-->
নিত্যপণ্যের ঊর্ধগতি

উত্তাপ রাজনীতিতে

রাজন ভট্টাচার্য
উত্তাপ রাজনীতিতে
পণ্যমূল্যের ঊর্ধগতির প্রতিবাদে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি

অব্যাহতভাবে দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে দেশের রাজনীতিতে। ইতোমধ্যে এই ইস্যুতে একের পর এক কর্মসূচি ঘোষণা করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। তবুও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুকে সামনে এনে রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা চালাচ্ছে। শুধু তাই নয় ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি দিচ্ছে।

সরকারের সমালোচনা করে কড়া ভাষায় কথা বলছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। বসে নেই বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও। তারাও এ ব্যাপারে সোচ্চার। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বাজার সিন্ডিকেটদের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করলেও খুব একটা কাজে আসছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি জাতীয় সংকট। ধারাবাহিকভাবে বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় কমবেশি সবাইকে সংসার পরিচালনায় বেগ পেতে হচ্ছে। এই সুযোগে রাজনৈতিক দলগুলোর ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই।

তবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোন দল বা গোষ্ঠী যেন ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করতে না পারে- এ ব্যাপারে সরকারসহ ক্ষমতাসীন দলকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনে বাড়তি ভর্তুকি দিয়ে হলেও পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির মুখে বেকারের সংখ্য আড়াই কোটির বেশি। কোভিডের ধাক্কার বন্ধ হয়েছে ছোট বড় বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাই বেকারের সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।

দেশের অর্থনীতি ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা যখন চলছে ঠিক তখনই পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ফলে সব শ্রেণির মানুষ কষ্টে আছেন। কমদামে টিসিবির পণ্যের লাইনে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। লাইনে দাঁড়াচ্ছেন মধ্যবিত্তরাও।

এদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারে কড়া হুশিয়ারি ও সয়াবিন তেলের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণার পর বাজারে কমতে শুরু করেছে ভোজ্যতেলের দাম, যদিও সরকারের বেধে দেওয়া দামে এখনো তা আসেনি। চালসহ অন্যান্য পণ্যও আসেনি হাতের নাগালে।

এদিকে বাজারে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ও ‘কারসাজি’ থামাতে শুক্রবার থেকেই মুদি দোকানিদের কাছে পাকা রশিদ নিশ্চিত করতে অভিযান শুরু করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

আগামী ২৮ মার্চ দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ ঊর্ধ্বগতি ও নাগরিক সংকট বাড়ার প্রতিবাদে আধাবেলা হরতাল ডেকেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। গতকাল শুক্রবার এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক।

তিনি বলেন, হরতাল সফল করতে সারা দেশে সভা, সমাবেশ, পদযাত্রা, মিছিল, বিক্ষোভ ও প্রচারপত্র বিলি করার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। সাইফুল হক বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় অতি জরুরি খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক ও লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে দেশের মানুষ আজ নাকাল।

গরিব ও স্বল্প আয়ের কোটি কোটি মানুষের খাদ্য গ্রহণ কমে গেছে। জনগণের এক বড় অংশ দুইবেলাও ভালোভাবে খেতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে দিলে দেশ আবারো দুর্ভিক্ষাবস্থায় নিপতিত হতে পারে।

খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গত ১০ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৪৮ শতাংশ, ডিজেলের দাম বেড়েছে ৮২ শতাংশ, আর পানির দাম বেড়েছে ২৬৪ শতাংশ।

এর মধ্যে আবার চরম স্বেচ্ছাচারী পন্থায় পানির দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে ৬০ শতাংশ, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনা রয়েছে ১১৭ শতাংশ আর তেলের দাম বৃদ্ধির কোনো সীমারেখা নেই। এটি স্পষ্ট যে চাল-ডাল-পেঁয়াজ সিলিন্ডার গ্যাসসহ অতি জরুরি খাদ্য দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।

খাদ্য দ্রব্যের দাম কমাও, মানুষ বাচাঁও’ দাবিতে আজ রাজধানীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে ১৪ দলের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি ও তেল-গ্যাসসহ ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গণফোরাম ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও ঢাকা জেলার উদ্যোগে আজ শনিবার মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছে গণফোরামের একাংশ।

এ ব্যাপারে দলের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। জনগণের পকেট কেটে লুটপাট, কালোবাজারি, ভেজাল খাদ্যসহ নানা অপকর্মে লিপ্তরা এই দুঃশাসনের রাজত্ব সৃষ্টি করা ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট।

এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। পণ্যের দামে মানুষের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। মধ্যবিত্তরা টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছে কম দামে জিনিসপত্র কিনছে।

তাই রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই এই কর্মসূচির আহ্বান। পণ্যের দাম বাড়ার প্রতিবাদে সপ্তাহব্যাপী সারাদেশে কর্মসূচি পালন করছে কমিউনিস্ট পার্টি।

একই দাবিতে আজ বেলা ১১টায় পল্টন মোড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে হকার্স ইউনিয়ন। শুক্রবার পল্টন মোড়ে নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সিন্ডিকেটের কারসাজি বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের উৎপাদন-সরবরাহ ভালো, আমদানিতেও কোনো সমস্যা নেই।

এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সিন্ডিকেটের কারসাজি। দায় এড়ালে চলবে না, সরকারকেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি বলেন, সিন্ডিকেট ধ্বংস করার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এটা করতে পারলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

রমজানকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আমদানি হয়ে গেছে। সুতরাং দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মাঠ গরমের চেষ্টায় বিএনপি।

অন্য কোন ইস্যু কাজে লাগাতে না পারলেও এবার অনেক বেশি তৎপর দলটি। বসে নেই তাদের প্রধান মিত্র জামায়াতও। দীর্ঘদিন পর বৃহস্পতিবার জামায়াতকে একই ইস্যুতে রাজধানীতে প্রকাশ্যে মিছিল করতে দেখা গেছে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী কৃষক দল আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, কৃষকের পণ্য এখানে আমরা যারা ভোক্তা হিসেবে আছি তাদের ১০ থেকে ১২ গুণ দিয়ে কিনতে হয়।

অর্থমন্ত্রী আছেন একজন, যিনি অতীতে আদম ব্যবসা করতেন। পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন সরকারের আমলা। তিনি বলেন, হ্যাঁ দাম বেড়েছে, কিন্তু বিশ্বের তুলনায় কম বেড়েছে। এখানে মুদ্রাস্ফীতি অনেক কম আছে।

জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় খুশি নয় আওয়ামী লীগের মিত্র দলগুলোর নেতারা। তারাও নানাভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শরিক নেতারা সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত তুলে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

অপরদিকে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করার জন্যই কেবল নয়, গণবণ্টন ব্যবস্থার যথাযথ বিবেচনায় এখনই পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। সরকারের সমালোচনায় বসে নেই বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও।

দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে জিনিসপত্রের দাম প্রধান ও বড় সমস্যা। আজ যেটা বেশি কাল সেটার লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ে। দুই নম্বর সমস্যা হলো মানুষ বেকার হচ্ছে।

মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই, সম্মান নেই।নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সমালোচনা করে সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। প্রতিদিন মানুষের ব্যয় বাড়ছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না।

প্রতিদিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। দেশের মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এদিকে আসন্ন রমজান মাসে জনগণকে জিম্মি করে অতিলাভ ও লোভে ব্যবসা না করতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

বৃৃহস্পতিবার সচিবালয়ে তার দপ্তরে ব্রিফিংয়ের সময় ব্যবসায়ীদের প্রতি এ আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম ঠিক রাখতে অবৈধভাবে পণ্য মজুদদারি, সংরক্ষণ এবং যেকোনো সিন্ডিকেট গঠন থেকেও বিরত থাকতে হবে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, বাজারে যেকোনো ধরনের জনস্বার্থবিরোধী সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব শেখ হাসিনা মেনে নেননি, নেবেন না এবং প্রশ্রয়ও দেবেন না। যেসব ব্যবসায়ী রমজান মাসকে টার্গেট করে জনস্বার্থবিরোধী এবং বাজার অস্থিতিশীল করার কাজ করেন তাদের সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি সংযম হওয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, রমজান মাসে কোনো অসাধু চক্রের কারসাজি সফল হতে দেওয়া হবে না। দেওয়া হবে না কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্যবৃদ্ধির অপচেষ্টাকে।

এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে, বাজার ব্যবস্থায় মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেই বাজার পরিস্থিতি মনিটর করছেন বলে জানান কাদের।

এদিকে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট নেই, যারা কৃত্রিমভাবে খাদ্য পণ্যের সংকট তৈরি করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে একথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো করোনায় অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।

কোভিডের ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেনি অনেক পরিবার। এই প্রেক্ষাপটে বারবার পণ্যের দাম বাড়া মানেই মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাওয়া।

তিনি বলেন, এই অজুহাতে যেন বিরোধী কোনো শক্তি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে না পারে এ ব্যাপারে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। মানুষের প্রয়োজনে সব রকমের উদ্যোগ নিয়ে বাজারের পণ্যমূল্য কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।

মন্তব্য

Beta version