-->
শিরোনাম

সহজের হাতে ট্রেনের টিকিট

রাজন ভট্টাচার্য
সহজের হাতে ট্রেনের টিকিট
চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি টিকিটের জন্য সহজ লিমিটেডকে ২৫ পয়সা সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। যেখানে সিএনএসকে দিতে হতো প্রায় তিন টাকা।

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে রেলে একচেটিয়া ট্রেনের টিকিট বিক্রি করেছে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস)। সম্প্রতি সিএনএসকে বাতিল করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সহজ ডট কমের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী নতুন ব্যবস্থাপনায় শুরু হয়েছে ট্রেনের টিকিট বিক্রি কার্যক্রম।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন চুক্তিতে রেলওয়ের আয় অনেক বাড়বে। কমবে লোকসান। এর ধারাবাহিকতায় রেলওয়ের কম্পিউটার টিকিটিং কার্যক্রম নতুন সার্ভিস প্রোভাইডার সহজ ডট কমের কাছে হস্তান্তর বিষয়ে অবহিত করতে আজ রেল ভবনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হবে।

রেল মন্ত্রণালয় বলছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সহজ ডট কমের সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়। চুক্তির পর ২১ দিনের মাথায় কম্পিউটার টিকিটিং কার্যক্রমের সবকিছু বুঝে নেওয়ার কথা সহজের। পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তিতে সহজ বলছে এই মেয়াদে ওয়েবসাইড ও অ্যাপ থেকেই আয় হবে কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকা।

চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি টিকিটের জন্য সহজ লিমিটেডকে ২৫ পয়সা সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। যেখানে সিএনএসকে দিতে হতো প্রায় তিন টাকা। ১৮ মাস তারা আগের সার্ভারে কাজ চালিয়ে যাবে নতুন প্রতিষ্ঠান। এরপর প্রয়োজন হলে টিকিটিং সিস্টেমে পরিবর্তন আনবে এবং নিজস্ব সার্ভারে কাজ করবে।

সম্প্রতি চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘সিএনএস নিয়ে রেলের সঙ্গে বেশ ঝামেলাও ছিল। আমাদের বাজে অভিজ্ঞতাও হয়েছে। মামলা থেকে ধরে কত কিছুই না হয়ে গেল। এগুলো কোনো দিনই মেনে নেওয়া যায় না। তারা এক-একটি টিকিটের জন্য প্রায় তিন টাকা নিত। আর এখন সহজ নেবে মাত্র ২৫ পয়সা। টিকিট বিক্রয়ে আমরা সবচেয়ে বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হই এবং রেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছিল টিকিটিং ব্যবস্থা নিয়ে।

তিনি বলেন, এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য আমরা আগেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক বাধা অতিক্রম করে আজকের এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি। চুক্তির মাধ্যমে সেই নতুন যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি। আমরা এখন ৫০ শতাংশ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করছি- আগামীতে ১০০ ভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রয় করা হবে।

রেলসূত্রে জানা গেছে, টিকিট বিক্রির রেলের ওয়েবসাইট ও অ্যাপ থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ পাঁচ বছরে ২৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা আয় হবে বলে প্রাক্কলন করেছে সহজ। ২০ কোটি টিকিট বিক্রির জন্য রেলের কাছ থেকে নেবে পাঁচ কোটি টাকা। সিএনএস পাঁচ বছরে ২০ কোটি টিকিটের জন্য ২৪ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রতি টিকিটের জন্য এক টাকা ২০ পয়সা চেয়েছিল।

রেলের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সহজকে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত করলে, এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) অভিযোগ করে সিএনএস। আদালত সিপিটিইউকে রায় দেয়, বিজ্ঞাপনের টাকা সরকারের। তা সহজ নিতে পারবে না। কিন্তু হাইকোর্ট সহজের পক্ষে রায় দিয়েছেন।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা এম কাদির বলেছেন, আগামী ১৮ মাস রেলের সার্ভারের মাধ্যমে, এরপর নিজস্ব সার্ভারের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করবে।

সিএনএসের দাবি ছিল, একসঙ্গে ৪০ লাখ ‘হিট’ গ্রহণে সক্ষম তাদের সার্ভার। কিন্তু সারা বছরই ওয়েবসাইটে, অ্যাপে প্রবেশ করতে সমস্যা হতো। আর ঈদের সময় ঢোকাই যেত না।

২০০৭ সালে পাঁচ বছরের জন্য ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকায় সিএনএসকে অপারেটর নিয়োগ করে রেল। কিন্তু নেয় ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে আবার পাঁচ বছরের জন্য ৩১ কোটি ৩২ লাখ টাকায় নিয়োগ পায় সিএনএস। ট্রেন ও আসন বাড়ায় ৪১ কোটি ৯০ লাখ টাকা নেয়।

অপারেটর নিয়োগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দরপত্র আহ্বান করে রেল। গত এক বছর ধরে চুক্তি ছাড়াই টিকিট বিক্রি করছে সিএনএস। প্রতিটি টিকেট বিক্রির জন্য অপারেটরকে চার টাকা ৩৫ পয়সা চার্জ দরপত্রে প্রাক্কলন করেছিল রেল। সহজ লিমিটেড বাংলাদেশ ও সিনেসি আইটির যৌথ উদ্যোগ (জেভি) ২০ কোটি টিকিট বিক্রি করে দিতে ৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং সিএনএস ২৪ কোটি টাকা প্রস্তাব করে।

রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে চলতি অর্থবছর ৮ কোটি যাত্রী পরিবহনের পরিকল্পনা করেছিল রেলওয়ে। পাশাপাশি মালামাল পরিবহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩২ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) যাত্রী, মালামালসহ রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১০ শতাংশ।

চলতি অর্থবছর যাত্রী পরিবহণ বাবদ রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। একইভাবে মালামাল পরিবহণে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অর্থবছরে একাধিক নতুন ট্রেন চালুও নতুন কোচ সংযোজনের কারণে রাজস্ব আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধির আশায় ছিলেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত রেলওয়ে ১৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ৬৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রেলওয়ে। চলমান রয়েছে আরও ৪৮টি প্রকল্প, এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ সত্ত্বেও গত ১০ বছরে রেলওয়ের লোকসানের পাল্লা কেবল ভারীই হয়েছে।

রেলের অর্থ দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে রেলওয়ের লোকসান হয়েছিল ৬৯০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর তা বেড়ে ৮৬২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। একইভাবে ২০১১-১২ অর্থবছর ৯৬৩ কোটি, ২০১২-১৩ অর্থবছর ৭৫৮ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ৮০১ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৮৭২ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ১ হাজার ৩২৫ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ১ হাজার ৫৩১ কোটি ও ২০১৭-১৮ অর্থবছর ১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা লোকসান করে রেল।

গত অর্থবছর (২০১৮-১৯) সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। নতুন চুক্তি অনুযায়ি রেল পরিচালনায় ব্যয় অনেক কমে আসবে।

মন্তব্য

Beta version