আবহাওয়ার নেতিবাচক পরিবর্তনে চরম হুমকিতে পড়ছে বিশ্ববাসী। তবে মানুষের বিভিন্ন কাজকর্ম আবহাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, জলবায়ু হলো বিভিন্ন আবহাওয়ার সমন্বয়।
আবহাওয়া তথা জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন বিশ্বের মানবজাতির স্বাভাবিক বেঁচে থাকার পথে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আটটি দেশের উপকূলীয় এলাকায় বিরূপ পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে বলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। প্রতি বছর আবহাওয়ার বিরূপ আচরণে বাংলাদেশের পরিবেশ ও আর্থসামাজিক অবস্থা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, কোনো নির্দিষ্ট স্থানের নির্দিষ্ট সময়ের বায়ুর উষ্ণতা, বায়ুচাপ, বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি উপাদানের দৈনন্দিন অবস্থাই আবহাওয়া। আবহাওয়া হলো বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরের দৈনন্দিন অবস্থা। স্থানভেদে আবহাওয়া সহজেই পরিবর্তিত হয়। কোনো কোনো জায়গায় আবহাওয়া প্রতিদিন, এমনকি প্রতি ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়।
জলবায়ুর বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, জলবায়ু হলো কোনো বিস্তৃত অঞ্চলের কমপক্ষে ৩০ থেকে ৫০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থা। জলবায়ু হলো বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরের দীর্ঘকালীন সামগ্রিক অবস্থা। জলবায়ুর পরিবর্তন হয় স্থানভেদে ও ঋতুভেদে।
প্রতিদিনের ব্যবধানে কোনো অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তিত হয় না। জলবায়ু হলো বিভিন্ন আবহাওয়ার সমন্বয় বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশে বছরের প্রথম থেকেই অস্থির আচরণ শুরু করেছে আবহাওয়া। গত বছরও বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের মানুষ ক্ষণে ক্ষণে আবহাওয়ার রূপবদল দেখেছে।
মুখোমুখি হয়েছে ঘন ঘন নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি আর বন্যার। এ বছরও বাংলাদেশকে এসবের জন্য তৈরি থাকতে হবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অন্তত তা-ই বলছে। এর কারণ বঙ্গোপসাগরের ওপর উষ্ণবায়ু সক্রিয় আছে। শীত, গরম, রোদ-বৃষ্টি, নিম্নচাপ-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ছাড়িয়ে এটা কৃষি, মৎস্যসহ সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে।
পাল্টে দিচ্ছে আমদানি-রপ্তানির হিসাব। ছায়া ফেলছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা, বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস আর আবহাওয়া সংক্রান্ত একাধিক গবেষণায় জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা এই ইঙ্গিত দিচ্ছেন।
আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে গত এক যুগে প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়তির দিকে। যেমন বৃষ্টি, বন্যা, ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের কারণে দেশের উপকূল থেকে উত্তরাঞ্চল-সব এলাকার মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েক গুণ।
গত বছরের বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টি বেশি হয়েছে। বর্ষার শুরুতে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়, আর পুরো বর্ষায় বৃষ্টি বেশি হয়েছে ১১ শতাংশ। ফলে গত বছর বর্ষার শুরুতে ফসলের এক দফা ক্ষতি হয়।
গত বছর বন্যা হয়েছিল পাঁচ দফায়। বন্যা দীর্ঘায়িত হয়েছিল ৪১ দিন। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ পরিচালিত ‘বাংলাদেশে গ্রিন হাউসের প্রভাব এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন, শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ক্রমে উত্তপ্ত হচ্ছে।
গবেষণায় আরো জানা যায়, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা পানি বিভাজন এলাকাতে ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাতের বৃদ্ধিতে সে দেশে বন্যার ভয়াবহতা বাড়বে। অন্যদিকে, বর্ধিত বৃষ্টিপাত নদীর প্রবাহ বাড়িয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির জন্যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশকে প্রশমিত করতে সাহায্য করতে পারে।
তবে যে তথ্যটি সবচেয়ে আশঙ্কাজনক তা হলো, তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠে বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আতিক রহমান বলেন, দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কতগুলো প্রভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। গত বছর চার মাস ধরে চারটি বড় ধরনের বন্যা হয়েছে। ওই বছরই ঘূর্ণিঝড় ‘ধাম্পান’ হয়েছে।
এরপরই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘নিসর্গ’। এত কম সময়ের ব্যবধানে ঘূর্ণিঝড় আগে হয়নি। আগে প্রতি ১০ বছরে একটি বড় ঘূর্ণিঝড় হতো। এখন প্রতি দু-তিন বছরে বড় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। এছাড়া তাপমাত্রা ও ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনও চোখে পড়ছে।
অনিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে। যখন হওয়ার কথা তখন হচ্ছে না। যখন হওয়ার কথা না তখন হচ্ছে। কদমসহ বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক ফুল যখন ফোটার কথা তা ফুটছে না। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে সাইক্লোন, বন্যা ও খরার জন্য। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হচ্ছে।
মন্তব্য