'বয়স হয়ে গেছে, এখন অনেক কথাই স্মরণ শক্তির বাহিওে চলে গেছে। তারপরও স্মৃতি ভুলিনাই যে ভাইরা কেমনে মারা গেল। এক ভাই (শহীদ নান্নু খান) মারা গেল দুপুরে। আরেক ভাই (শহীদ বাকী বিল্লাহ) মারা গেল সন্ধ্যায়।
এই জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে একই দিনে (৭১ সালের ২৬ মার্চ বুধবার) দুই ভাইকে মারছে বিহারিরা। দাফন-কাফন কিছুই হইল না। তখন নিজেগো জীবন নিয়া পলানোটা দায় হইয়া গেল। আজকে এতটা বছর হইল মা- বোন থুইয়া দুই ভাই চইলা গেল। ভাই হারিয়ে আমার যে এখন কি করুন অবস্থা তা উপরয়ালাই জানে। এই দুনিয়ায় আমার কেউ নাই। মা ছিল একমাত্র সঙ্গী। তবে এই মাকেও হারাইছি বেশ কিছুদিন আগে। এখন আমি নিস্ব আমাকে দেখার মত কেউ নাই। মানুষ যা দান করে তা নিয়েই আমার জীবন চলে।'৬৩ বছর বয়সী আয়েশা খাতুন এভাবেই ৭১ সালের ২৬ মার্চে তার দুই ভাইয়ের দোসরদের হাতে নির্মম ভাবে শহীদ হওয়ার কাহিনী বর্ননা দেন ভোরের আকাশের কাছে। বর্তমানে আয়েশা খাতুন মিরপুর ১১ নম্বরে থাকেন।
দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পালিয়ে ছিল মিরপুরের জল্লাদ খানায়। মিরপুরের এই অংশট স্বাধীন হয় ৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির দিকে। ৩০ জানুয়ারি রাতভর যুদ্ধ হয়ে ৩১ তারিখ ভোরে স্বাধীন হয় মিরপুর।
মিরপুরের এই জল্লাদখানায় মুক্তিকামী জনতাকে ধরে ধরে হত্যা করা হত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসররা মুক্তিকামী মানুষদের হত্যা করে তাদের গলাকাটা লাশ এখানে ফেলে রাখত।
এমনই একজন শহীদ নয়া মিয়া ওরফে গ্যাদা মিয়া। যুদ্ধের পুরো সময়টা তিনি মিরপুরের বাইরে ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশ স্বাধীন হলে তিনি মিরপুরে আসেন, নিজ বাড়ির অবস্থা দেখার জন্য। সেদিনই বিহারিরা তাঁকে ধরে এনে এই জল্লাদখানায় নির্মমভাবে হত্যা করে। তারই ছেলে মো. হায়াতুল ইসলাম (গাউস মিয়া) তিনি মায়ের মুখে শুনেছেন কিভাবে ঘাতকদের হাতে বাবা শহীদ হয়েছিলেন।
তিনি ভোরের আকাশ কে জানান, ’১৯৭১ এর ২৬ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী যখন হামলা করল, আমার বাবা ও মা যুদ্ধে আটকা পড়ে গেলেন মিরপুরের বাসায়। আমি তখন মায়ের গর্ভে ছিলাম, মিরপুর তখন বিহারিদের নিয়ন্ত্রনে ছিল, সব বাঙালিকে মিরপুর ছাড়তে হয়েছিল। বাঙালি পরিচয় পেলেই ওরা মেরে কুপে ফেলে দিত। বাবা ও মাকে আমাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া বিহারি একটি ঘরে তালাবন্ধ করে লুকিয়ে রেখেছিল এবং মেইন গেইটে তালা থাকত।
কয়েকদিন পর যখন পরিস্থিতির অবনতি হল, ভাড়াটিয়া বলল, আপনাকে লুকিয়ে রাখলে আমাদের উপর বিপদ আসতে পারে। তাই আপনারা রাতের অন্ধকারে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
তারপর রাত্রে পিছনের দেয়াল টপকে মাকে নিয়ে বাবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সব কিছু ফেলে পায়ে হেটে দারুস সালাম হয়ে আজিমপুর ষ্টাফ কোয়ার্টার পৌঁছলেন। সেখানে সহকর্মী সামাদ সাহেবের বাসায় উঠলেন। কিন্তু তারা কেউ বাসায় ছিল না। সেখানেই তারা আশ্রয় নিলেন।
পরদিন, আসাদ গেট, সেন্ট যোসেফ হাইস্কুল এণ্ড কলেজের প্রিন্সিপাল ব্রাদার রালফস আমার পিতাকে তার স্কুলে চাকরি দিয়ে আমাদের পরিবারকে রক্ষা করেন। ২০ জুলাই ১৯৭১ ব্রাদার রালফকে বাবা বললেন, 'স্যার আমার বাড়ি সাজানো সংসার, সবকিছু এক নজর দেখে আমি চলে আসব, আমি ৫ টায় আজ ছুটির পর বাড়ি দেখতে মিরপুরে যাব।'
স্যার নিষেধ করলেন, বাবা শুনলেন না। বললেন, আমার এক বন্ধু আমার সাথে যাবে। তারা ৫ টার পর স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়লেন। দুজনের হাতেই একটি করে ছাতা ও টিফিন ক্যারিয়ার ছিল। মাকে না বলেই অফিস থেকে এই মিরপুরে এসে আর তিনি ফেরেননি। মা বলতেন, 'সেই সেন্ট যোসেফের কেয়ারটেকার বাড়ির খবরাখবর দিতে আসা যাওয়া করত। তার কথাতেই বিশ্বাস করে তিনি মিরপুর গেলেন। আর কোনদিন ফিরলেন না।‘
ঢাকার মিরপুর ১০ এ অবস্থিত এই বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের উপর পাকিস্তানের পৈশাচিক অত্যাচারের কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম এই জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে নির্যাতিত অসংখ্য বাঙালীদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল।
মিরপুরবাসীর প্রদত্ত তথ্য অনুসারে ১৯৯৯ সালে ১৫ই নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক ডিভিশনের সহযোগিতায় 'জল্লাদখানা' নামে পরিচিত ওয়াসার এই পরিত্যক্ত পাম্পহাউজে খননকাজ চালায়। এখানে পাওয়া যায় ৭০ টি মাথার খুলি, ৫ হাজার ৩৯২টি অস্থিখন্ড এবং শহীদের ব্যবহার্য নানা সামগ্রী। যার মধ্যে সববয়সী নারী-পুরুষেরই দেহাংশ ছিল বেশি। মেয়েদের শাড়ী, ফ্রক, ওড়না, অলংকার ও জুতা সহ শহীদদের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র পাওয়া যায় কূপ দুটিতে। ১৯৭১ সালে জনবিরল এলাকার এই পাম্প হাউজটিকে বধ্যভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা।
হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষজনকে পানিভর্তি অন্ধকূপে ফেলে দিয়ে ঘাতকেরা ভেবেছিল এভাবে চিরতরে চাপা পড়বে তাদের কৃত গণহত্যার নিদর্শন। প্রায় তিন দশক পরে বধ্যভূমির কূপ থেকে উঠে এসেছে শহীদের নারী-পুরুষ-শিশুর শবদেহ, বিভিন্ন নিদর্শনের মধ্য দিয়ে বলতে চাইছে অনেক কথা। গণহত্যার শিকার মানুষজনের নীরব আকুতিতে ধ্বনিত হচ্ছে সত্যের ও ন্যায়ের বাণী। কালের এই ঘন্টাধ্বনি বাজছে আজো।
জল্লাদখানা বধ্য ভূমির সুপার ভাইজার প্রমিলা বিশ্বাস বলেন, বর্বর পাকিস্থানিরা স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালীদের তাদের ট্রেনিং প্রাপ্ত জল্লাদ দিয়ে পাম্প হাউজের কূপের সামনে শিরোচ্ছেদ করে পানি ভর্তি অন্ধকার কূপে ফেলে দিত। ধারণা করা হয় এই বধ্যভূমির বড় বড় সেফটি ট্যাঙ্ক ও আসে পাশের অন্যান্য জায়গায় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার বাঙালির লাশ গুম করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে এই স্থান প্রথম দফায় খননের পর প্রায় তিন ট্রাক হাড়গোড় জাতীয় জাদুঘরে নেওয়া হয়েছিল বলে জানান এই জল্লাদ ভূমির কর্তব্যরত সুপার ভাইজার।
২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ। ওই দিন থেকেই দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে সকল শহীদ পরিবারের দাবি ২৫শে মার্চকে যেন আন্তর্জাতিক গনহত্যা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
তিনি বলেন, বছরে দুই সময় তিন দিন যাবৎ শহীদ দের স্মরণে এই বধ্য ভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ২৪ থেকে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা উৎসব এবং ১৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় উৎসব পালিত হয়। সরকার যেন এই গণ হত্যায় শহীদদের পরিবারের তালিকা করে। পরিবারদের ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা করে।
মন্তব্য