সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে মারাত্মক প্রভাব। গবেষণায় উঠে এসেছে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ুও কমছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের আয়ুষ্কাল গড়ে তিন বছর কমছে।
লাইফ ইনডেক্সের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুদূষণে সারা দেশের মানুষের আয়ু কমছে প্রায় ৫ বছর ৪ মাস। এর প্রভাবে শুধু রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। প্রতিষ্ঠানটির ১৯৯৮ সালে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, ওই সময়ে বায়ুদূষণের মানুষের গড় আয়ু কমেছিল ২ বছর ৮ মাস। সেখানে ২০১৯ সালে এই আয়ু কমে দাঁড়িয়েছে ৫ বছর ৪ মাসে। পরিসংখ্যা ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। বিশেষজ্ঞরা বলছে, শুধু মানুষের গড় আয়ুই কমছে না, এর প্রভাবে জনস্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।
পরিবেশ, চিকিৎসা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের অর্থই হচ্ছে বাতাসের ভাসমান কণা এবং বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। দূষণ বাড়লে শ্বাসরোগ এবং ফুসফুসে দুরারোগ্য ব্যাধি হচ্ছে- এ কথা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে। সম্প্রতি গবেষণায় উঠে এসেছে শুধু ফুসফুস বা শ্বাসনালি নয়, বায়ুদূষণ শরীরের গুরুত্ব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওপরেরই মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে ক্যানসার, হৃদরোগ এমনকি অবসাদও দেখা দিতে পারে। অনান্য অঙ্গে ক্যানসারের জন্য বায়ুদূষণ অনেকাংশে দায়ী। একই কথা হৃদরোগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা বলছেন, দূষণের লাগাম টানতে না পারলে বায়ুদূষণ সৃষ্ট এসব রোগের প্রকোপ কমে আসবে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে এই কারণে। গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষের আয়ুষ্কালের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে বায়ুদূষণ দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ে রূপ নিয়েছে। আগের জরিপগুলোতে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।
সম্প্রতিক জরিপে দূষিত বায়ুদূষণের দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানে এসেছে বাংলাদেশের নাম। ফলে দেশে বায়ুদূষণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। তারা বলছেন বায়ুদূষণ যে শুধু স্বাস্থের ওপর প্রভাব ফেলছে তা নয়। দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই বায়ুদূষণকে নিছক পরিবেশগত ইস্যু হিসেবে দেখলে হবে না। এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সরাসরি সম্পর্ক আছে। এর কারণে দেশে ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বলেন, আগে ইটভাট এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বায়ুদূষণের বড় ধরনের ভূমিকা রাখত। সম্প্রতি বছর ধরে রাজধানীতে বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ কারণে দূষণ ছড়াচ্ছে মহামারি আকারে। তিনি বলেন, ছোট বড় সব ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ ছাড়পত্র আবশ্যক। কিন্তু এই বিধান না মেনে কাজ করার ফলে দ্রুত দূষণ ছড়াচ্ছে। আইন অনুযায়ী এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর এটা দেখেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
পরিবেশ আইন অনুযায়ী এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে রাস্তায় পাানি ছিটানো, নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখাসহ সব ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য। কিন্তু বেশির ভাগ সময় এই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। সরেজমিন রাজধানীর খামারবাড়ি, রোকেয়া সরণি ঘুরে দেখা গেছে ব্যাপক মাত্রায় ধূলিদূষণ বেড়েছে। বিশেষ করে একটি যানবাহন চলে যাওয়ার পর চারদিকে ধূলিতে অন্ধকার হয়ে পড়ছে। আশপাশে থাকা লোকজনকে বাধ্য হয়ে নাকমুখ ঢেকে রাখতে হচ্ছে। শুধু রাজধানীর খামার বাড়ি বা রোকেয়া সরণি নয়। পুরো রাজধানীতে যেখানে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে সেসব এলাকার চিত্র মোটামুটি একই ধরনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। এ কারণে কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। হাঁপানি, ক্যানসার, হৃদরোগ, ফুসফুসের অসুখসহ অনেক রোগের কারণ বায়ুদূষণ। এ রোগ বৃদ্ধির জন্যও বায়ুদূষণ দায়ী। এছাড়াও সারা বিশ্বে বায়ুদূষণের দৈনিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা মোট বিশ্ব উৎপাদনের ৩ থেকে ৪ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে শিশুরা। প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বলেন, শিশুরা বড়দের তুলনায় ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকে। এই ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেওয়ায় দেহে ধূলিকণা বেশি পরিমাণ প্রবেশ করছে। আর বয়ষ্করা এমনিতেই নানা ধরনের ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত। ফলে এই দূষণ তাদের রোগের প্রকোপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও তরুণরাও নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। তারা বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি হয় শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এর মধ্যে হাঁপানি, ফুসফুসের কাশি ছাড়াও ক্যানসার, স্ট্রোক ও কিডনির সমস্যা হয়। এ জন্য বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত।
মন্তব্য