যানজটের নগরী ঢাকাকে সচল করতে মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলমান। হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। বাস র্যাপিড ট্রানজিট- বিআরটি নির্মাণের কাজের অগ্রগতি আছে।
এর বাইরে আরো বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রকল্প নির্মাণের চিন্তা রয়েছে। যখন ঢাকাকে যানজটমুক্ত করার এতসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে, তখন গোটা রাজধানী কার্যত যানজটে অচল।
গেল এক মাসের পরিসংখ্যান বলছে, সকাল আটটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত যানজটে নগরীর বেশিরভাগ সড়ক অচল থাকে। অর্থাৎ ২ র্যাপিড৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ ঘণ্টা স্বাভাবিকভাবে পথ চলার কোনো সুযোগ নেই।
আস্তে আস্তে হাঁটার গতি যানবাহনের গতির প্রায় সমান হতে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ঢাকার যানজট কি কমবে না! নাকি এই বিপদের বোঝা মাথায় নিয়েই আগামী দিনগুলোতেও নগরবাসীকে চলতে হবে!
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসেও তীব্র গরমের মধ্যে যানজটে নাকাল হতে হয়েছে নগরবাসীকে। ওয়ারীতে কামরুন্নেসা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা মালঞ্চ পরিবহণের একটি বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় দোষীদের শাস্তি ও বিচারের দাবিতে বৃহস্পতিবারে জয়কালী মন্দিরের সামনের সড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচিতে অংশ নেয় কামরুন্নেসা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ওয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়, নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এতে পুরো এলাকায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। এর বাইরেও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রায়ে সব সড়কেই দিনভর যানজটে নাকাল হতে হয়েছে নগরবাসীকে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজটের কথা বলে উন্নয়ন প্রকল্প সরকার হাতে নিলেও রাজধানীতে মানুষের প্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ নেই।
এখন এই শহরে দুই কোটি মানুষের বসতি। তিন লাখ যানবাহন যে শহরে চলতে পারে, সেখানে ১৯ লাখ যানের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে গাড়ি। উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ২৫ ভাগের স্থলে আট ভাগ সড়কের অর্ধেক দখল।
বিভিন্ন এলাকায় সড়ক সংকুচিত হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে ২০৩৫ সালের মধ্যে পাঁচটি মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শেষ হলেও যানজট নিরসন দুরূহ হবে। মেট্রোরেলেও স্বস্তি ফেরার কারণ নেই।
সেই সঙ্গে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা সম্ভব হয়নি গেল ৩০বছরেও। ফলে ইচ্ছামতো একেকটি সেবা সংস্থা রাজধানীতে নিজেদের মতো করে কাজ করে। এতে জনদুর্ভোগ আরো চরমে ওঠে।
পাশাপাশি সাধারণ যাত্রীদের জন্য গণপরিবহণ দিন দিন বাড়ার স্থলে কমছে।সাবওয়ে বা পাতাল রেল নির্মাণের পরিকল্পনা \ ঢাকা শহরে যানজট নিরসনে সাবওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সমীক্ষা চলছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
মন্ত্রী বলেন, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এর ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এটি সম্পন্ন হয়ে অর্থায়ন নিশ্চিতসাপেক্ষে সাবওয়ে নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সাংসদ দিদারুল আলমের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মানুষের প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হবে।
বিভিন্ন দাতা সংস্থার পরামর্শে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে রাজধানীর যানজট নিরসন হবে না। প্রয়োজন বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। যা আমারা খুব একটা দেখি না।
সড়ক পরিবহণ সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, দিন দিন এই শহরে গণপরিবহণ চলাচলে উপযোগিতা হারাচ্ছে। মাত্রা ছাড়াচ্ছে যানজট। আমরা চাই বাস্তবসম্মত ও দ্রæত বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ। অন্যথায় ঢাকায় এক সময় যানবাহনের গতির চেয়ে হাঁটার গতি বেশি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আমন্ত্রণে সম্প্রতি বাংলাদেশে আসেন আন্দ্রে বারাতা। তিনি পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অব বয়রা ইনটেরিয়রের অধ্যাপক।
রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সময় তাকেও ঢাকার অন্যতম সমস্যা যানজটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যানজটের জন্য তিনি সাবওয়েকে একটি সমাধান হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের জনসংখ্যা যদি দেড় কোটি হয়, সে তুলনায় পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের জনসংখ্যা মাত্র ১০ লাখ। সেখানেও যানজটের সমাধানের জন্য সাবওয়ে ব্যবহার করা হয়।
লিসবন শহরে পাহাড়-পর্বত থাকায় শহরটিতে সাবওয়ে বানানো বেশ কঠিন এবং ব্যয়বহুল ছিল। সে তুলনায় ঢাকা শহরের জায়গা সমতল। লিসবনের তুলনায় কম খরচে এখানে সাবওয়ে তৈরি করা যাবে।
ফলে সাবওয়ে হতে পারে ঢাকার যানজটের একটি সমাধান। ’তিনি ঢাকা শহরের যানজটকে সংগঠিত বিশৃঙ্খলা হিসেবে অভিহিত করেন।
সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনায় (২০১৫-৩৫) ঢাকা মহানগর এলাকায় পাঁচটি মেট্রোরেলের কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি লাইনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
পরিবহণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, চলমান মেট্রোলাইনের (উত্তরা-মতিঝিল) কাজ শেষ হলে এই করিডরে যারা থাকবেন, তারা একটি নির্ভরযোগ্য বাহন পাবেন, তাদের জন্য সুবিধা হবে।
কিন্তু এতে স্টেশনের আশপাশের এলাকায় নতুন বিড়ম্বনা তৈরি হবে। মেট্রোর সঙ্গে অন্যান্য সড়কের সমন্বিত উন্নয়ন না হওয়ায় এটি হবে। আর ২০৩৫ সালের মধ্যে সব ক’টি মেট্রোলাইনের কাজ শেষ হলেও যানজট কমবে না, যদি বাস সার্ভিসের উন্নতি না হয়। কারণ, তখনো মোট যাত্রীর ১৭ শতাংশ মেট্রো ব্যবহার করবেন। অন্যদের ভরসা থাকবে বাস।
যানজটের সঙ্গে পরিবহণ খাতের অব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ঘাটতিসহ নানা বিষয় জড়িত। তাই এর সমাধান কবে নাগাদ হবে, সে আশার কথা কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না।
এর মূল কারণ ঢাকার পরিবহণ ব্যবস্থায় কোনো সমন্বয় নেই। ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএসহ নানা সংস্থার কার্যক্রম এর সঙ্গে জড়িত।
অবশ্য এসবের মধ্যেও আশার কথা শোনালেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম নাজেম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚তত্ব বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, শুধু মেট্রোর ওপর ভরসা না করে মূল সড়ক ও কমিউনিটিভিত্তিক সড়ক ব্যবস্থাপনার প্রতি জোর দিতে হবে, তবে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে।
তার মতে, মেট্রোর সঙ্গে মূল সড়কে উন্নত বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। কমাতে হবে ব্যক্তিগত যানবাহন। বাড়াতে হবে মিনিবাস, উন্নতমানের লেগুনা সেবা। ঢাকায় যে হারে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, সে তুলনায় বাড়েনি বাসের সংখ্যা।
বিআরটিএর তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত ঢাকা মেট্রো এলাকায় ৩৭ হাজার ৫৯৩টি বাসের নিবন্ধন হয়েছে। গত বছর ঢাকায় বাস নেমেছে ১ হাজার ২১৩টি।
পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাতে নৈরাজ্য বন্ধ করে সুষ্ঠুভাবে বাস চালাতে পারলে এবং রাস্তায় মানসম্পন্ন বাস নামালে যাত্রী ভোগান্তি কমার পাশাপাশি যানজট পরিস্থিতিরও যথেষ্ট উন্নতি হবে।
রাজউকের দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকার সড়কের মাত্র ১ শতাংশ দখলে রাখে বাস। অথচ প্রায় ৬০ শতাংশ যাত্রী পরিবহণ করে এই বাস।
রাজউকের এক সমীক্ষার তথ্যমতে, সংস্থাটির আওতাধীন এলাকায় ১৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার সড়ক আছে। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে ১০ শতাংশ রাস্তা ২০ ফুটের বেশি চওড়া। ৫ ফুট বা এর কম প্রশস্ত গলি প্রায় ১৩ শতাংশ, ১০ ফুট বা এর চেয়ে কম প্রশস্ত সড়ক প্রায় সাড়ে ৫৯ শতাংশ।বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজার মতে, এই সরু রাস্তাও যানজট সৃষ্টির একটি কারণ। এ জন্যই ঢাকার সড়ক প্রশস্ত করতে বলা হচ্ছে। রাস্তা প্রশস্তের পাশাপাশি যানজট সৃষ্টিতে জড়িত অন্য কারণগুলোর সমাধান করলেই পরিস্থিতি সহনীয় হবে। ঢাকায় যানজটের প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় ব্যক্তিগত গাড়িকে। কিন্তু ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত
ঢাকা মেট্রো এলাকায় ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫০৯টি ব্যক্তিগত গাড়ির নিবন্ধন করা হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে নিবন্ধন নিয়েছে ২ হাজার ৭২৪টি ব্যক্তিগত গাড়ি। এ হিসাবে প্রতিদিন ঢাকায় অন্তত ৪৬টি নতুন গাড়ি রাস্তায় নেমেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধিও যানজট তীব্র করছে।মিরপুর সড়ক নিয়ে রাজউকের করা একটি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ৭৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ সড়ক দখলে রাখে ব্যক্তিগত গাড়ি। এসব গাড়িতে যাত্রী পরিবহণ করা হয় মোট যাত্রীর প্রায় ২৫ শতাংশ। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা না কমলে অচিরেই ঢাকা শহরের যানজট পরিস্থিতি দুর্বিষহ পর্যায়ে চলে যাবে।
এদিকে রাজধানী ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নেমেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ এবং জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকা।
তিন বছর মেয়াদি ঢাকা রোড ট্রাফিক সেফটি প্রজেক্ট (ডিআরএসপি) প্রকল্পে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে তারা। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি যানজট থেকে মুক্ত করতে এ প্রকল্প ভ‚মিকা রাখবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত দায়িত্বরত কর্মকর্তা, বিভিন্ন সেবা সংস্থার কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশন, বিআরটিসি, বিআরটিএ, পরিবহণ মালিক-শ্রমিক-যাত্রী প্রতিনিধিরা এই প্রকল্পের কাজে যুক্ত থাকবেন।
এরই মধ্যে ৩০ মার্চ ডিএমপির সম্মেলন কক্ষে ঢাকা রোড ট্রাফিক সেফটি প্রজেক্ট (ডিআরএসপি) প্রকল্পের প্রথম যৌথ সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রকল্পটির দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান।
মন্তব্য