বিবিএস জরিপ

জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ

শাহীন রহমান
জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ
জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলীয় এলাকায় বেড়েছে নদীভাঙন। (ফাইল ফটো)

বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের কারণে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম নয়।

বাংলাদেশ পারিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০২১ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, গত ৬ বছরে দেশে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্তের হার বেড়েছে প্রায় ৫৫ ভাগ। ঘূর্ণিঝড়ে ৩৪ ভাগ। এছাড়া দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ৫৪ ভাগ মানুষ একবার করে আক্রান্ত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এর ফলে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত, খরা, জলোচ্ছ¡াস ও নদীভাঙনের মতো প্রকৃতি দুর্যোগ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এসব দুর্যোগের কবলে পড়ে আর্থসামাজিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

সম্প্রতি প্রকাশিত পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশে দ্বিতীয়বারের মতো এ সংক্রান্ত জরিপ চালানো হয়। ২০১৫ থেকে ২০২০ সময়কালের ওপর চালানো জরিপে বলা হয়েছে, গত ৬ বছরে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে ৫৪ দশমিক ৬৯ ভাগ মানুষ।

অথচ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের সময়কালে এই হার ছিল ৩৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ১০ বছরের বন্যায় আক্রান্তের হার বাড়ছে ২০ ভাগ। শুধু বন্যা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। গত ছয় বছরের সময়কালে ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্তের হার দেখানো হয়েছে শতকরা ৩৪ ভাগ।

বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ে ১৪ দশমিক ২২, খরায় ৪ দশমিক ৭২, জলমগ্নতায় ১০ দশমিক ১৬, শিলাবৃষ্টিতে ১৭ দশমিক ৮৩, জলোচ্ছ্বাসে ২ দশমিক ২৬, নদীভাঙনে ১০ দশমিক ৪, টর্নেডোতে ৫ দশমিক ২৮, লবণাক্ততায় ৩ দশমিক ২৭, ভ‚মিধসে দশমিক ৪০ ভাগ এবং অন্যান্য দুর্যোগ যেমন- কুয়াশা, শৈত্যপ্রবাহ, পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রভৃতিতে শূন্য দশমিক ৯ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অথচ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালে সময়কালে এই হার উল্লেখ করা হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে ২১ দশমিক ৩১ ভাগ বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ে ১৪ দশমিক ৯৪, খরায় ১৪ দশমিক ৮০, জলমগ্নতায় ১৩ দশমিক ৮৮, শিলাবৃষ্টিতে ১১ দশমিক ৮৮, জলোচ্ছ্বাসে ৮ দশমিক ৬৫, নদী ভাঙনে ৪ দশমিক ৯৫, টর্নেডোতে ৪ দশমিক ১৪, লবণাক্ততায় ৪ দশমিক ০৯, ভ‚মিধসে শূন্য দশমিক ০৮ ভাগ, অন্যান্য দুর্যোগ যেমন- কুয়াশা, শৈত্যপ্রবাহ, পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রভৃতিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭ দশমিক ৯০ ভাগ।

বিবিএস জরিপে আরো উঠে এসেছে ২০১৫ থেকে ২০২০ সময়কালে ছয় বছরে দুর্যোগ প্রবণ এলাকার ৫৪ ভাগ মানুষ একবার, ৩১ ভাগ মানুষ দুবার, ১৫ ভাগ মানুষ তিন বা ততোধিকবার দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সময়কালে এই হার ছিল ৫৬ শতাংশের ক্ষেত্রে একবার, ২৭ ভাগের ক্ষেত্রে দুবার, ১৭ ভাগের ক্ষেত্রে তিন বা ততোধিকবার দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছিল।

২০১৫ থেকে ২০২০ সময়কালে দুর্যোগে আক্রান্ত লোকজন গড়ে ২১ দশমিক ৩ দিন কর্মহীন ছিল। এর মধ্যে বন্যার কারণে ৪২ দশমিক ৬৮ দিন, নদীভাঙনে ৩ দশমিক ৮৭, জলমগ্নতায় ৬ দশমিক ৭, খরায় ১ দশমিক ৬৩, জলোচ্ছ¡াসে ১ দশমিক ৫৫, ঘূর্ণিঝড়ে ২১ দশমিক ২৩, বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ে ৬ দশমিক ৫৫ দিন কর্মহীন ছিল।

অন্যদিকে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সময়কালে গড়ে ১২ দশমিক ১৩ দিন তারা কর্মহীন ছিল। এর মধ্যে বন্যায় ১৭ দশমিক ৬৩ দিন, নদীভাঙনে ১৬ দশমিক ৮৬, জলমগ্নতায় ১৪ দশমিক ৮৫, খরায় ১২ দশমিক ০৯, জলোচ্ছ¡াসে ১০ দশমিক ৮০, ঘূর্ণিঝড়ে ৯ দশমিক ৩৩, বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ে ৭ দশমিক ৬০ দিন দুর্যোগ প্রবণ কর্মহীন ছিল বলে এতে উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়ছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে দেশে বজ্রপাতে বছরে গড়ে ২০০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। ফলে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিগত ২০১৬ সাল থেকে বর্জ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি প্রতিরোধে সারা দেশে তালগাছ লাগানোর কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ও ভ‚-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়ার কারণে জলবায়ুতে পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ পরিসংখ্যান (ইসিডিএস) প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির হাল নাগাদের সঠিক তথ্যের অভাবে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

বিধায় বিবিএস ইসিডিএস প্রকল্পের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো এই জরিপ পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

তিনি বলেন, দুর্যোগ প্রবণ এলাকার দুর্যোগ প্রবণ এলাকার আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি খাতের উৎপাদনের ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা ছাড়াও মানুষের স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের বিপদাপন্নতা নিরূপণ করার জন্য এই জরিপ চালানো হয়েছে।

মন্তব্য