-->
শিরোনাম

নদীর দেশে পানির অভাব

* শুকিয়ে গেছে অনেক নদী * প্রধান প্রধান নদীর পানির প্রবাহ নেমেছে অর্ধেকে

শাহীন রহমান
নদীর দেশে পানির অভাব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাটির দেশে এভাবে পানির সংকট হতে পারে তা আগে কেউ কল্পনাও করেননি।

পানির দাবিতে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হতে না হতেই সেচ ও খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। সেচের পানি না পাওয়ায় দুই কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া রাজশাহীর প্রত্যন্ত এলাকায় পানির দাবিতে অভিনব সাইকেল র‌্যালি করেছে গ্রামবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাটির দেশে এভাবে পানির সংকট হতে পারে তা আগে কেউ কল্পনাও করেননি।

বলা হয়ে থাকে, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। হিমালয় থেকে উৎপন্ন হওয়া পানির ৯০ ভাগ এ দেশের ওপর দিয়ে সাগরে পতিত হয়। অথচ সেই নদীর দেশে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব প্রকট হচ্ছে। অধিকাংশ নদ-নদী শুকিয়ে প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। পানির জন্য প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন- পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং খাবার পানি সরবরাহ, নৌ-চলাচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশে রয়েছে ছোট-বড় ৪০৫টি নদী। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লি-ষ্ট। দেশের নদীগুলোর ৪৮টি সীমান্ত নদী, ১৫৭টি বারোমাসি নদী, ২৪৮টি মৌসুমি নদী।

উজানে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন কারণে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। সেই সঙ্গে দখল, ভরাট, আর বর্জ্যে নদীগুলো এখন নিস্তব্ধ স্রোতহীন। দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য এবং জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়ছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। দেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিরই একই দশা। তিস্তার পানি প্রবাহ ব্যাপকহারে কমে গেছে। পদ্মা, তিস্তা এখন মৃতপ্রায়। যমুনায় পড়েছে চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতক্ষ্যা দখল, ভরাট ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। যে পানির অপর নাম ছিল জীবন সেই বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যার পানির অপর নাম বিষ হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। যেখানে এখন জলজ ও প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে গেছে।

জাতিসংঘের সাবেক পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. এসআই খান তার গবেষণায় উল্লেখ করেন, উজানে পানি প্রত্যাহারের আগে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীতে পানির প্রবাহ ছিল ১ হাজার ৩শ’৪৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। বর্তমানে এ নদীগুলোতে পানির প্রবাহ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। উজানে পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণেই মূলত নদীর প্রবাহ দারুণভাবে কমে গেছে।

গবেষণায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ভাটিতে অবস্থিত হওয়ার কারণে প্রধান প্রধান নদী ও উপনদীগুলো দিয়ে হিমালয় অঞ্চল চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারত থেকে পানি ও পলিমাটি দেশের অভ্যন্তরে বয়ে নিয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। ফলে উর্বর পলিমাটি, অফুরন্ত পানিসম্পদ এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে দ্রুত জনবসতি গড়ে উঠেছে। এই পানি সম্পদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কৃষি সংস্কৃতি। কৃষি সংস্কৃতিকে ঘিরে মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে।

১৯৪৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটিতে। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বেশি। মাথাপিছু জমির পরিমাণ সবচাইতে কম। বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১২শ’। এর বিপরীতে জমির পরিমাণ মাত্র ২৪ ডেসিমল। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পানির চাহিদাও দারুণভাবে বেড়ে চলেছে। খাবার পানি, গৃহস্থালির কাজের পানি, কৃষি সেচ, শিল্প কারখানা, নগরায়ণ এবং জলাধারে পানি সংরক্ষণ প্রয়োজন মেটাতে পানির চাহিদা বাড়ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, ১.২- ২.৪ বিলিয়ন টন পলি নদীবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। পলি পড়ে নদীগুলোর তলদেশ ক্রমন্বয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নদীগুলো দখল, ভরাট ও দূষণের শিকার। ফলে নদীর পানি ধারণক্ষমতা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। নৌ চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ভাটির দেশ হিসাবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশে পানির সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। নৌ চলাচল, সেচ ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। নদীতে পানি কমে যাওয়া বা না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়া এবং নদী হারিয়ে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রকৃতি নির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে খরা মৌসুমে সেচ ও রাসায়নিক সারনির্ভর ধান চাষের ফলে ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির সংকট ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, সীমানা পেরিয়ে আসা ৫৪টি নদীর মধ্যে ২৫টি নদী মেঘনা নদীকে পানি দিয়ে থাকে। ভারত ইতোমধ্যে প্রায় সবগুলো নদীতে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ করেছে। অথচ ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভারতের বার্ষিক পানির প্রয়োজন ১ হাজার ১৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। তাদের পানির প্রাপ্যতা রয়েছে ৬ হাজার ৩ শ’ ৭৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। এর সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে পানি হারভেস্টিং করলে আরও ১শ’৪২ বিসিএম পানি পাওয়া যাবে। ভারতের এই পানির প্রাপ্যতা প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ৭ গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে প্রাপ্য পানির ১৫ ভাগ ব্যবহার করলে নদীতে বাঁধ বা ব্যারেজ দিয়ে উজানে বাংলাদেশের পানি সরানোর কোনো প্রয়োজন হয় না।

এছাড়া নেপালে বৃষ্টিপাত ও বরফ গলা পানি থেকে অসংখ্য নদীর উৎপত্তি হয়েছে। অনেক প্রাকৃতিক জলাধার থাকায় সারা বছরই পানি পাওয়া যায়। আবার ভুটানে জনসংখ্যা কম হওয়ায় পানির চাহিদা কম। সেদেশে ৯০ ভাগের বেশি পার্বত্য অঞ্চল। অজস্র ঝর্ণাধারার পানি পর্বতের ঢাল বেয়ে নদীতে নেমে যাচ্ছে। সাধারণত তারা ঝর্ণার পানি দিতে কৃষি ও খাবার পানির প্রয়োজন মেটাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ ভাটিতে অবস্থিত হওয়া এবং জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে এই পানির সংকট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিবেশ সংগঠন পবাসহ একাধিক পানি, নদী ও পারিবেশ সংগঠনের সম্প্রতি এক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে পানি অভাবে মার্চ এবং এবং এপ্রিল মাসে প্রায় ৪ লাখ অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে। অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, বাড়ছে ঝুঁকি। কোনো কোনো এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।

এতে আরো বলা হয়েছে ভাটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশে পানি সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। উত্তরাঞ্চলের নদীসমূহ শুস্ক বালুচরে পরিণত হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। বিদ্যমান এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানী ঢাকা চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এ ধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২ হাজার ৯৫২ ও ১৩ হাজার ৫২৮ হেক্টর। ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে ২ হাজার ১০৪ ও ১২ হাজার ৭১৮ হেক্টর। ২০০৮ সালে ১ হাজার ৯৯১ ও ৬ হাজার ৪১৫ হেক্টর। ইতোমধ্যে প্রায় ৭০% নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পাল্লা দিয়ে চলছে ভরাট কার্যক্রম। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নিম্নাঞ্চল হারিয়ে যাবে।

মন্তব্য

Beta version