-->

হাওরপাড়ের কান্না

* ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে নির্ঘুম রাত এলাকাবাসীর * ৮০ ভাগ পাকলেই ধান কাটার পরামর্শ * সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনায় বেশি ক্ষতি

রাজন ভট্টাচার্য
হাওরপাড়ের কান্না
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় ছায়ার হাওর রক্ষার চেষ্টা স্থানীয়দের। ছবি- ভোরের আকাশ

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরপাড়ে ‘মাওতির’ বাঁধ এলাকায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। উজানের ঢলে নদী ভরে টইটম্বুর। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে পানি। বাঁধ চুঁইয়ে পানি ঢুকছে সবুজঘেরা হাওরে। অথচ আগামী ২০ দিনের মধ্যেই পাকা বোরো ধানের ফসল কেটে ঘরে তোলার কথা ছিল। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে ডুবে যেতে পারে আশার ফসল। তাই এলাকার মানুষের চোখে ঘুম নেই। পানির চাপে যেখানেই মাটি দুর্বল হচ্ছে, সেখানেই নতুন করে হাতে হাতে মাটি দেওয়া হচ্ছে। ফেলা হচ্ছে বালুর বস্তাও। সবাই দু-হাত তুলে প্রার্থনা করছেন পানির ছোবল থেকে হাওরটির যেন শেষ রক্ষা হয়।

যারা একবারের এই ফসলের আশায় ধারদেনা করে বিনিয়োগ করেছেন তাদের হৃদয়জুড়ে হাহাকার আরো বেশি। মনের অজান্তেই নির্ঘুম চোখে ঝরছে জল। যেসব হাওর ইতোমধ্যে তলিয়ে গেছে সেখানেও কৃষকরা বসে নেই। আগামী দিন কীভাবে চলবে? কপালে এমন চিন্তার ভাঁজ নিয়ে আধাপাকা ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।

শাল্লার মুক্তারপুর-সুলতানপুর ৮৪-৮৫ পিআইসি বাঁধও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সেখানে আশপাশের গ্রামের শত শত মানুষের ভিড়। বাড়ি থেকে কোদাল, খুন্তি, ডালি নিয়ে নারী-পুরুষ থেকে শিশুরাও আসছে বাঁধ রক্ষায়। সবাই সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন সোনার ফসল রক্ষায়।

হাওরাঞ্চলের মানুষের অভিযোগ, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি ও যথাসময়ে কাজ না হওয়ায় ফসল ডুবির অন্যতম কারণ বলছেন তারা। তাই বাঁধ নির্মাণে জড়িতদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের শেষ নেই কৃষকদের।

গতকাল একই উপজেলার কৈয়ার হাওরের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। একে একে জেলার ছয়টির বেশি হাওর এখন পানির নিচে। এই দুঃসংবাদ ছড়িয়েছে পুরো অঞ্চল থেকে আশাপাশের জেলায়। তাই ফসল রক্ষায় আতঙ্ক এখন হাওরপাড়ের সব মানুষের মধ্যেই।

গেল প্রায় এক সপ্তাহ ধরেই হাওর অধ্যুষিত সাত জেলায় দুঃসংবাদ শোনা যাচ্ছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামছে নিচু এলাকায়। নদ-নদীর পানি বাড়ছে অব্যাহতভাবে। একে একে ডুবছে হাওর। ঝুঁকির মধ্যে অনেক এলাকার ফসল। অকালবন্যায় নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

শাল্লা উপজেলার দাড়াইন নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে কৈয়ারবন ও পুটিয়া হাওর ডুবে গেছে। সেই সঙ্গে তলিয়ে গেছে হাওরের ৪০ হেক্টর জমির ফসল। হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে কাঁচাপাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কৈয়ারবন ও পুটিয়া হাওরে ৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। কিন্তু কোনো জমির ফসল এখনো কাটা হয়নি। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। ২০১৭ সালের পর গত কয়েক বছরে নদীর পানি এমন উচ্চতায় প্রবাহিত হয়নি।

১২১ কোটি টাকার হিসাব চান স্থানীয় মানুষ

একে একে হাওর পানিতে ডুবে যাওয়ায় বুধবার সুনামগঞ্জ শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেছেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি পিআইসি গঠনে অনিয়ম করা হয়েছে। এ কারণেই হাওরের বাঁধের করুণ অবস্থা। আমরা বলেছিলাম স্বচ্ছতা রেখে কাজ করার জন্য। কিন্তু তারা সেটি করেনি। সুনামগঞ্জ জেলায় ১২১ কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই টাকাগুলো গেল কোথায়? আজ কেন প্রশাসন স্থানীয় মানুষকে বাঁধে এগিয়ে আসতে বলে। সরকার এত টাকা দেওয়ার পরও আজ কৃষক কেন যাবেন বাঁধ রক্ষা করতে?’

একে একে ডুবছে হাওর

ধর্মপাশার সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রুবেল আহমদ বলেন, বাঁধ ভাঙায় নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, বারহাট্টার কিছু অংশের ফসল ডুবে যাবে। বাঁধ ভাঙায় কমপক্ষে দুই হাজার হেক্টর ফসল ডুববে। স্থানীয় সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোকারম হোসেন বলেন, বাঁধের যে অংশে ফাটল ধরেছিল, সেই অংশ মেরামত করতে করতে বিকেলে অন্য অংশ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। তিনি বলেন, বাঁধের কাজ কারা করেছে আমি জানি না, আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগেই কাজ দেওয়া হয়েছে।

শাল্লার বাসিন্দা অমন জানান, উজানের পানিতে ফসলের সর্বনাশ হতে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে সর্বশেষ অকাল বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। এবার ধান কাটার প্রায় শেষ মুহূর্তে হাওর ডুবতে যাচ্ছে। তাই মানুষের মুখে হাসি নেই। চাপা কান্না বিরাজ করছে। অনেকেই বাঁধ এলাকায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। সর্বশক্তি নিয়োগ করে সবাই মিলে ফসল রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

এদিকে নেত্রকোনার হাওরঅধ্যুষিত ছয়টি উপজেলার কৃষকরা ১৩৪টি হাওরের ফসল রক্ষা নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছেন। ইতোমধ্যে খালিয়াজুরীর চুনাইহাওর, বাইনারদরচরসহ তিনটি হাওর পানিতে তলিয়ে গেছে। কির্তনখোলা বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাঁটল। ৪১ হাজার হেক্টর জমির ধান শেষ পর্যন্ত কাটতে পারবেন কি না এ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। খালিয়াজুরী এলাকার কৃষক কালু জানান, ভাটি এলাকায় এক ফসলের জমি। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। আমরা জমির ধান দিয়েই পুরো বছর চলি। একবার ফসল ডুবলে পাঁচ বছর পর্যন্ত আমাদের কষ্ট হয়। অভাব দেখা দেয় গোটা অঞ্চলে।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগে ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার তাল হাওরের ডুবাইল বাঁধ ভেঙে ১৮৫ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়েছে। সুনামগঞ্জের উজানের নদ-নদীতে পানি কিছুটা কমলেও ভাটির নদীগুলোতে পাহাড়ি ঢলের চাপে ঝুঁকির মুখে রয়েছে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলো; যা নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, তিনটি বাঁধের মধ্যে শাল্লা উপজেলার দুটি তাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিইসি) কাজের বাইরে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বুধবার বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ে বা তৎসংলগ্ন সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই। উত্তর পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল আছে।

৮০ ভাগ ধান পাকলেই কাটার পরামর্শ

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওরে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ধান। বিভিন্ন নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে ধানের জমি। জেলার ইটনার পর এবার নিকলী উপজেলায় প্লাবিত হচ্ছে কাঁচা-পাকা ধানের জমি। ৮০ ভাগ ধান পাকলেই দ্রুত কেটে ফেলতে পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি অফিস।

তবে চরাঞ্চল ছাড়া এখনো প্রধান প্রধান হাওর সুরক্ষিত রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ফসলরক্ষা বাঁধের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কবস্থায় রয়েছে প্রশাসন। গত এক সপ্তাহে জেলার ইটনা ও নিকলীর নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলে প্রায় ৭শ একর ধান পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল আলম। তিনি জানান, এখনো ফসলরক্ষা বাঁধের ভেতর পানি প্রবেশ করেনি। নদী তীরবর্তী নিচু এলাকার ধান ডুবেছে। তবে ৮০ ভাগ ধান পাকলেই দ্রুত কেটে ফেলতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিশোরগঞ্জে চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে।

বাকি ৯২ ভাগ বাঁধের আংশিক কাজ সম্পন্ন

সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ধীরগতির পাশাপাশি ৫৮ ভাগ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে অনিয়ম হয়েছে বলে উঠে এসেছে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার জরিপে। রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গণশুনানি ছাড়াই পিআইসি গঠনেরও অভিযোগ রয়েছে।

জরিপে বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত সময়ে মাত্র ৮ ভাগ ফসল রক্ষা বাঁধে শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাকি ৯২ ভাগ বাঁধের আংশিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সব মিলিয়ে বাঁধে মাটি ভরাট, ঘাস লাগানোসহ সার্বিকভাবে গড়ে ৬২ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।

সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী ৫০ মিটার দূর থেকে বাঁধের মাটি আনার কথা থাকলেও ৩৫ ভাগ বাঁধে এই নিয়ম মানা হয়নি। অনিয়মের মাধ্যমে বাঁধের কাছ থেকে মাটি দেওয়া হয়েছে। যেসব বাঁধে মাটির কাজ সম্পন্ন করা হয়নি, এসব বাঁধে দুরমুজ (কম্পেকশন) ও ঢাল বজায় রাখার কাজও অসম্পূর্ণ।

নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে প্রকল্প প্রাক্কলন ও পিআইসি গঠনে বিলম্ব, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, হাওর থেকে দেরিতে পানি নামা ও ড্রেজার মেশিনের স্বল্পতা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঁধের মাটির দুষ্প্রাপ্যতা ও প্রকল্প গঠনে অনিয়মের সমস্যা পুরনো। হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের বিকল্প হিসেবে উজান ও ভাটিতে নদী খনন জরুরি। নির্মাণ করতে হবে স্থায়ি বাঁধ, খনন করতে হবে নদী। রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ পাওয়া বন্ধ, কাজের হাত বদল ঠেকানো জরুরি। বিচারের আওতায় আনতে হবে অপরাধীদের। অন্যথায় হাওরের সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না। নষ্ট হবে ভাটির মূল্যবান সোনালি ফসল।

মন্তব্য

Beta version