করোনা মহামারির কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার পুরোদমে আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হবে। উৎসবকে বর্ণিল করে তুলতে আয়োজকরা সেরে নিচ্ছেন শেষ দিকের প্রস্তুতি। এ বছর পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান যেমন থাকবে, তেমনি চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাও বের হবে। এবারে চারুকলার বর্ষবরণের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- রজনীকান্ত সেনের গান ‘নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’। এ ছাড়া সারা দেশে বৈশাখী মেলা এবং শোভাযাত্রার আয়োজনও থাকবে। জেলা-উপজেলায় থাকবে কুইজ প্রতিযোগিতা, নববর্ষের সাজ এবং লোকজ মেলা।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত দুই বছরের প্রাণহীন পহেলা বৈশাখ পেরিয়ে এবছর সারা দেশে বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে বাঙালির প্রিয় সর্বজনীন অনুষ্ঠান বাংলা নববর্ষ-১৪২৯ উদযাপন করা হবে। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির কারণে সব ধরনের আয়োজন থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবারও। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশে সভায় প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনকে কমিটির সদস্য-সচিব করে ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও নববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে শৃঙ্খলা উপ-কমিটি ও মঙ্গল শোভাযাত্রা উপকমিটি নামে দুটি উপ-কমিটিও গঠন করা হয়েছে। যদিও গত বছর রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজনের প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে এসে সরকার সেই অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়।
এদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার ছায়ানটকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে রমনার বটমূলেই এবারের অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এবার স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি বিবেচনা করে শিল্পীর সংখ্যা অল্প কয়েকজন কমিয়ে আনা হবে। অনুমতির পরে আর কোনো বাধা নেই। তারা এরইমধ্যে মহড়া শুরু করে দিয়েছেন। প্রতিবার ১২৫ জনের মতো শিল্পী এ আয়োজনে অংশ নেন।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা গত এক সপ্তাহ ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চারুকলা বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। জয়নুল গ্যালারির সামনে একদল শিক্ষার্থী মাটির সরায় মাছ, পাখি, ফুলসহ নানা চিত্র এঁকে চলেছে। আরেক দল নানা ধরনের মুখোশ তৈরি করছে। কিছু শিক্ষার্থী হাতপাখা, চরকিসহ নানান জিনিস বানাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, এবারের শোভাযাত্রায় ঘোড়া ও টেপা পুতুলসহ মোট পাঁচটি বড় মোটিভ থাকবে। ভেতরে শিক্ষার্থীদের নির্দেশনায় কয়েকজন শ্রমিক মোটিভগুলোর কাঠামো তৈরি করছেন।
ঢাবি অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ও আয়োজক ব্যাচের তরিকুল ইসলাম হীরক বলেন, দুই বছর পর আবার শুরু হচ্ছে উৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি। গত বছর উৎসব হয়েছে খুব স্বল্প পরিসরে। লকডাউন থাকায় গত বছর সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। এবার লকডাউন না থাকায় উদ্দীপনাটি ভালোই আছে। এবার উৎসবমুখর পরিবেশে পালন হবে বলে আশা করছি। আমাদের প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। কাজ প্রায় শেষের দিকে।
লোক ও লালন সংগীতশিল্পী রাজিয়া সুলতানা শিমুল বলেন, করোনা সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলেছে। তবে এবার বৈশাখ উদযাপন হবে এটা শুনেই খুব ভালো লাগছে। তাছাড়া আমরা চাই, এবার বছরের প্রথম দিনটা যেন আনন্দ-উৎসব মুখর হয় সে কামনায় করি।
ঢাবি চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, রমজানের কারণে এবার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ সকাল ৭টার পরিবর্তে সকাল ৯টায় হবে। স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারটা সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। মাস্ক এবং সামাজিক দূরত্বের ওপর জোর দেওয়া হবে। বাংলা একাডেমি, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে নববর্ষের আয়োজন থাকবে।
করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর বাংলা নববর্ষ উদযাপন ও মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা না হলেও এ বছর পহেলা বৈশাখে আবারো মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। তবে মেট্রোরেলের কারণে চলাচলের পথ সরু হয়ে যাওয়ায় এটি শুরু হবে চারুকলা অনুষদের পরিবর্তে টিএসসি থেকে।
এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, গত দুই বছর অতিমারির কারণে এই উৎসব হতে পারেনি। এবার আমরা অব্যশই আনন্দের সঙ্গে এই উৎসবে যোগ দেব। এটা বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এটি বাঙালির দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এছাড়া বাঙালির বাঙালিত্ব আত্মপরিচয়টা পহেলা বৈশাখের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধরা দেয়।
অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ড. মনোরঞ্জন ঘোষাল বলেন, পহেলা বৈশাখের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কটা হলো আত্মার সম্পর্ক। কারণ বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে এটা মিশে আছে। এটি সম্রাট আকবরের সময় শুরু হয়। এছাড়া বাঙালির এত বড় অসাম্প্রাদায়িক উৎসব আর নেই। পহেলা বৈশাখের উৎসবে জাতি ভেদে করা হয় না। এটা সমগ্র জাতির উৎসব।
সংস্কৃতি কর্মী ফেরদৌসী আক্তার লিমা বলেন, জাতি, বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষের এ ঐতিহ্য মাটি ও মানুষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এখানে কোনো জাতিভেদ ও ধর্মভেদ নেই। নৃ-তাত্ত্বিক ও সামাজিক অন্যান্য বৈশিষ্ট্য মিলে নববর্ষ উৎসব প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা।
ঢাবি জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজের কারণে চলাচলের পথ সরু হয়ে যাওয়ায় চারুকলা অনুষদের পরিবর্তে টিএসসি থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা স্মৃতি চিরন্তন হয়ে আবারো টিএসসিতে এসে শেষ হবে। ১৪ এপ্রিল ঢাবি ক্যাম্পাসে সব ধরনের অনুষ্ঠান বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, নববর্ষের আগের দিন সন্ধ্যা ৭টার পর ঢাবি ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন ও নববর্ষের দিন কোনো ধরনের যানবাহন প্রবেশ করা যাবে না। মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। এছাড়া নববর্ষের দিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়া গেলেও কোনোভাবেই আর প্রবেশ করা যাবে না। নববর্ষের দিন ঢাবি ক্যাম্পাসে বসবাসরতরা নিজস্ব গাড়ি নিয়ে নীলক্ষেত মোড়সংলগ্ন গেট ও পলাশী মোড়সংলগ্ন গেট ব্যবহার করতে পারবেন।
এ বছর পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মুখোশ পরা ও ব্যাগ বহন করা যাবে না। চারুকলা অনুষদের প্রস্তুত করা মুখোশ হাতে নিয়ে ঘোরা যাবে। এছাড়া ভুভুজিলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনাও দিয়েছেন ঢাবি কর্তৃপক্ষ। নববর্ষের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট বন্ধ থাকবে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আগতরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের জন্য চারুকলা অনুষদের বিপরীতের গেট, বাংলা একাডেমির বিপরীতের গেট ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট সংলগ্ন গেট ব্যবহার করবেন এবং বের হওয়ার সময় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট সংলগ্ন গেট, রমনা কালীমন্দিরসংলগ্ন গেট ও বাংলা একাডেমির বিপরীতের গেট ব্যবহার করতে পারবেন। ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা ও আর্চওয়ে স্থাপন করা হবে এবং তা মনিটরিং করার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হবে।
মন্তব্য