করোনা মহামারিতে হারিয়ে গিয়েছিল ব্যক্তি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। অবশেষে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে জীবন। সেই স্বাভাবিক ছন্দ থেকে উৎসারিত হয়েছে ১৪২৯ বঙ্গাব্দের মঙ্গল শোভাযাত্রা। কূপমণ্ডুকতা, গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচিত হয় এই যাত্রা।
দীর্ঘ দুই বছর পর বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) থেকে শুরু হয় বাংলা নববর্ষের উৎসব মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবার শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য নেওয়া হয়েছে রজনীকান্ত সেনের গান থেকে, ‘নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার মলিনতা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তাড়নায় আনন্দ উৎসব-মুখর পরিবেশে টিএসসির সড়কদ্বীপ থেকে শুরু হয়ে ভিসি চত্বর ঘুরে পুনরায় টিএসসি এসে শেষ হয় শোভাযাত্রা।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান শোভাযাত্রায় অংশ নেন।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, 'দীর্ঘ দুই বছর পর আমাদের বাঙালির প্রাণের উৎসবে একত্রিত হতে পেরেছি। পহেলা বৈশাখ দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সাংস্কৃতিক উৎসবের মাধ্যমে আমরা জঙ্গিবাদ ও অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণা পাই।’
ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সম্প্রীতির, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণে সকলের প্রতি আহ্বান জানান৷
এবারে শোভাযাত্রায় ঢাউস আকারের কোনো মোটিফ তৈরি করা হয়নি, বরং এবারের মূল আকর্ষণ ছিল ফুল ও পাখির সমন্বয়ে তৈরি কারুকার্যময় বৃহদাকার গ্রামীণ মোটিফ। গ্রাম্য মেলা থেকে উৎসারিত মোটিফটি ধারণ করেছে ব্যতিক্রমধর্মী ভিন্নতার ছোঁয়া। যেখানে তিনটি সার্কেলে তিনটি পাখি, মাঝখানে রয়েছে ফুল। ওপরের বড় পাখি আমাদের মুক্তির প্রতীক। বিশালাকারের পাখিটি অতীতের গ্লানি মুছে দিয়ে বলবে অনাগত সুদিনের কথা। ফুল সেখানে নান্দনিকতা ছড়াবে।
এছাড়াও শোভাযাত্রায় স্থান পেয়েছে টেপা পুতুল, মাছ, পাখি ও ঘোড়া চারটি বিশালাকৃতির শিল্পকাঠামো। সঙ্গে পুষ্পাকৃতির বিশাল চরকি। অংশগ্রহণকারী নানা বয়সী মানুষের হাতে হাতে রাজা-রানী, বাঘ, পেঁচার মুখোশসহ লোকজ নানা অনুষঙ্গ।
মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে বিশাল মাথার রাজা রাণী। এক একজন রাজা রানী নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে ভিড়ের মাঝেও অনন্য। লোক সংস্কৃতির মাটির টেপা পুতুলের অবয়বে তৈরি হয়েছে হাতি, ঘোড়া, বিশাল একটি পুতুল, মাছ সামনে নিয়ে মাছরাঙা, রাগী একটি ষাঁড়। লোকে লোকারণ্য এ আনন্দ মিছিলের মাঝে মাঝেই আছে বিশালাকার সব প্রতিকৃতি।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম এই অনুষ্ঠান মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু আশির দশকে। তখন বাংলাদেশে স্বৈরাচারী সামরিক শাসন চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিল্পীরা বিভিন্ন প্রতিকৃতি, মুখোশ, বিশাল সব ভাস্কর্য নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায়।
এবার শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। প্রথমে এলিট ফোর্স র্যাব, সোয়াট টিম, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পুলিশ। এছাড়াও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের টিমও তৎপর ছিলেন।
শোভাযাত্রার পুরো পথে সিসিটিভি ক্যামেরা ও পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ নিরাপত্তা বেষ্টনী দেখা যায়। ফলে বাইরের কেউ শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারেননি। গতবারের মতো এবারও মুখোশ ব্যবহার ও ভুভুজেলা বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। নিরাপত্তার জন্য রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় কেন্দ্রীয় রাস্তা দুপুর পর্যন্ত বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম ছিল আনন্দ মিছিল।
১৯৮৯ এর আনন্দ মিছিল ১৯৯৬ সালে এসে নাম পায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। সেই থেকে এখন পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজন করে আসছে এ উৎসবের।
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।
চারুকলার সঙ্গে তাল রেখে দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজ নিজ আয়োজনে করে মঙ্গল শোভাযাত্রা।
মন্তব্য