-->
দিনে এক বেঞ্চে ১৪৯৮ মামলা নিষ্পত্তি

হাইকোর্টের ইতিহাস বিচার নিষ্পত্তিতে

এম বদি-উজ-জামান
হাইকোর্টের ইতিহাস বিচার নিষ্পত্তিতে
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজল

মামলার বিচার করার ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন হাইকোর্টের দুই বিচারপতি। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এক দিনেই ১ হাজার ৪৯৮টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। এর আগে এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ এক দিনে ১ হাজার ১২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছিলেন।

গতকালের আগ পর্যন্ত ওটাই ছিল এক দিনে মামলা নিষ্পত্তির সর্বোচ্চ রেকর্ড। এক দিনে একটি বেঞ্চে এতসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলার জট কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল মামলা ছিল ১ হাজার ৫০১টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৯৮টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন এ আদালত। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী গতকাল মোট ১২ বেঞ্চে একই জাতীয় ৪ হাজার ৩১২টি মামলা ছিল। এর মধ্যে ১০টি বেঞ্চে ৩ হাজার ৪৩৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।

মূলত হত্যা, ধর্ষণ, মানব পাচার, মাদকের মামলায় অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেওয়ার পর এ-সংক্রান্ত রুল বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে ছিল। সংশ্লিষ্ট মামলায় একবার জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর তা বিভিন্ন সময়ে বর্ধিত হয়েছে। কিন্তু প্রথমবার জামিনের সময় জারি হওয়া রুল আর নিষ্পত্তি হয়নি। এরকম হাজার হাজার রুল অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। এর কারণে হাইকোর্ট বিভাগের মামলার স্তূপ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাবকে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সুপ্রিম কোর্টে মামলা ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন।

এরই অংশ হিসেবে জামিনসংক্রান্ত ওইসব পুরোনো রুল নিষ্পত্তির জন্য গত ১৭ এপ্রিল ১৩টি বেঞ্চ গঠন করেন। ওই ১৩টি বেঞ্চে বুধ ও বৃহস্পতিবার ৪৯৮ সংক্রান্ত ফৌজদারি বিবিধ মামলা নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এসব বেঞ্চকে ৪৯৮ ধারায় জামিনসংক্রান্ত ২০১৬, ১৭, ১৮ ও ২০১৯ সালের ফৌজদারি বিবিধ মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশের পর ওই চার বছরের ৪৯৮ ধারায় সৃষ্ট ফৌজদারি বিবিধ ৪ হাজার ৩১২টি মামলা গতকাল ১২টি বেঞ্চের কার্যতালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চেই দেওয়া হয় ১ হাজার ৫০১টি মামলা।

এক দিনে এত মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, এটা আমাদের সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে নজিরবিহীন। একজন বিচারকের মধ্যে ডেডিগেশন থাকলেই শুধু এমন নজির স্থাপন করা সম্ভব।

তিনি বলেন, আদালত প্রতিটি মামলা শুনেছেন ও আদেশ দিয়েছেন। আদেশের আগে রাষ্ট্রপক্ষের কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, রাষ্ট্রের বিশেষ কোনো নির্দেশনা আছে কিনা। আমাদের মতামত জানার পরই আদালত আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টে এ জাতীয় হাজার হাজার মামলা রয়েছে। যার কার্যকারিতা তেমন নেই। একবার জামিন নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট আইনজীবী এসব ক্ষেত্রে জারি করা রুল নিষ্পত্তির জন্য কোনো উদ্যোগ নেননি। ফলে তা পড়ে রয়েছে। এতে আদালতে হাজার হাজার মামলার নথি জমা হচ্ছে। ফলে মামলা ব্যবস্থাপনায় চরম অরাজকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রধান বিচারপতি বেশ কয়েকটি বেঞ্চকে এসব মামলা নিষ্পত্তির বিশেষ দায়িতব দিয়েছেন।

তিনি বলেন, এভাবে পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হলে সুপ্রিম কোর্ট মামলার ভার থেকে মুক্ত হবে। তিনি বলেন, এ সাফল্য উচ্চ আদালতে বিরাজমান মামলার জট নিরসনে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সুপ্রিম কোর্টের মামলা ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। এরই একটি প্রতিফলন হলো ৪৯৮ ধারায় জামিন আবেদনসংক্রান্ত ফৌজদারি বিবিধ মামলা নিষ্পত্তির জন্য ১৩টি বেঞ্চ গঠন।

তিনি বলেন, এর আগে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ১১টি ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ গঠন করেছিলেন প্রধান বিচারপতি, যা ছিল বাংলাদেশের বিচার বিভাগের এক নজিরবিহীন ঘটনা। এসব বেঞ্চে ৩৫টি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয়েছে।

তিনি বলেন, মামলার জট নিরসনের লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী পুরোনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চকে পুরোনো মামলা বিচারের জন্য দায়িত্ব দেন। বিশেষ করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় জামিন আবেদন করে জামিন নেওয়ার পর হাজার হাজার রুল বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকায় তা নিষ্পত্তির জন্য ১৩টি হাইকোর্ট বেঞ্চকে দায়িত্ব দেন।

জানা যায়, এ বেঞ্চের দুই বিচারপতি সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এসব মামলা কার্যতালিকাভুক্ত করতে বিশেষ উদ্যোগ নেন। প্রায় ২ হাজার মামলা তালিকাভুক্ত করে এক দিনেই নিষ্পত্তির টার্গেট ছিল ওই বেঞ্চের বিচারপতিদের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ৫০১টি মামলা। জানা গেছে, ওই ১৩টি বেঞ্চের প্রত্যেকটিতে প্রতিদিন ৩০০ করে মামলা দিতে সংশ্লিস্ট শাখাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের বেঞ্চ ১ হাজার ৫০০-এর বেশি মামলা নিজের বেঞ্চে নিতে উদ্যোগ নেন। এর আগে ২০১৯ সালে মামলার জট নিরসনের লক্ষ্যে তখনকার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন পুরোনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন। এরই অংশ হিসেবে হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চকে পুরোনো মামলা বিচারের জন্য দায়িত্ব দেন। বিশেষ করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় জামিন আবেদন করে জামিন নেওয়ার পর হাজার হাজার রুল বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকায় তা নিষ্পত্তির জন্য ১৪টি হাইকোর্ট বেঞ্চকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

এসব বেঞ্চকে প্রতি বৃহস্পতিবার ৪৯৮ ধারায় জামিনসংক্রান্ত ২০১৪ সালের ফৌজদারি বিবিধ মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশের পর সংশ্লিষ্ট ১৪টি হাইকোর্ট বেঞ্চে ৪৯৮ ধারায় সৃষ্ট ফৌজদারি বিবিধ মামলা নিষ্পত্তি হয়। এরই অংশ হিসেবে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে ওই বছরের ৭ মার্চ ৬৯২টি বিবিধ মামলা তালিকাভুক্ত হয়।

এত বিপুলসংখ্যক মামলা শুনানি শেষে সব মামলায়ই নিষ্পত্তি করে আদেশ দেন সেদিন। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১৪ মার্চ এক দিনে ১ হাজার ১২টি মামলা নিষ্পত্তি করে ইতিহাস গড়েছিলেন ওই হাইকোর্ট বেঞ্চ।

মন্তব্য

Beta version