নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে প্রায় সাড়ে চার হাজার নার্স বদলি অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে রোববার (২৪ এপ্রিল) নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের সভাকক্ষে তদন্ত কমিটির এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কমিটির সদস্যরা ঈদের পর আবারো বৈঠকে বসবেন বলে জানা গেছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য এবং সভায় অংশ নেওয়া স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্মসচিব মো. হামিদুল হক ভোরের আকাশকে জানান, সভায় আমরা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয় শুনেছি এবং পর্যালোচনা করেছি। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আবার বসতে হবে। কবে নাগাদ তদন্ত কমিটির পরবর্তী সভা হতে পারে-এ প্রশ্নের জবাবে যুগ্মসচিব জানান, আমরা ঈদের পর বিষয়টি নিয়ে আবার সভায় বসব। তখন হয়তো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
অভিযোগের বিষয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারের মুঠোফোনে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে বদলি বাণিজ্য নিয়ে দৈনিক ভোরের আকাশ ও আমাদের সময় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দৈনিক ভোরের আকাশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ‘তিন মাসে এত বদলি, লেনদেন কত’ শিরোনামে এবং আমাদের সময় পত্রিকায় ১২ ফেব্রুয়ারি ‘নজিরবিহীন বদলিতে শতকোটি টাকার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের সময় পত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইদুর রহমানকে আহবায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা) মো. হামিদুল হক, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের যুগ্মসচিব (পার) মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদ। এই কমিটি রােববার বৈঠক করেছে।
বদলি বাণিজ্য নিয়ে ভোরের আকাশ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহামারি করোনার সময় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ঢালাওভাবে নার্স বদলি করে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর। আর অধিদপ্তরের কয়েকজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বদলি বাণিজ্য করেন। প্রতি বদলিতে ২ লাখ ২০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদলির জন্য অনেক নার্সকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে এই সিন্ডিকেটকে। আরও বড় অভিযোগ, বদলির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও উপেক্ষা করা হয়েছে। বদলির জন্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, মন্ত্রীর প্রতিনিধি এবং অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের নিয়ম থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, বদলি সিন্ডিকেটের একজনের নাম মো. জামাল উদ্দিন। এই কাজে তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের ৯টি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে চারটি কুষ্টিয়ায়। তিনটি ব্যাংক হিসাব দনিয়া শাখায়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জেও তার ব্যাংক হিসাবের খোঁজ পাওয়া গেছে।
ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নার্স বদলি বাণিজ্যে যুক্ত এক ব্যক্তির নাম মো. জামাল উদ্দিন। ওই অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার ‘আত্মীয়’ পরিচয় দিয়ে এই বদলি বাণিজ্য করে ভবঘুরে অবস্থা থেকে কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। মো. জামাল উদ্দিন নামের একজনের ৮টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য এসেছে দৈনিক ভোরের আকাশের প্রতিবেদকদের হাতে। নার্সিং সেক্টরের কেউ না হয়েও ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া জামালের অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে কোটি কোটি টাকা। তার স্ত্রীর নামে করা একটি সঞ্চয়ী হিসাবে সাত মাসে জমা পড়েছে ৭২ লাখ টাকা।
জামাল উদ্দিনের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ৭ মাসে জমা হয়েছে ৭২ লাখ টাকা। বাড়ি কুষ্টিয়া হলেও জামাল থাকেন ঢাকার শনির আখড়া এলাকায়। জামালের দূর সম্পর্কের চাচা কমল, যিনি স্ত্রীর দিক থেকে নার্সিংয়ের এক কর্মকর্তার আত্মীয়। সেই সম্পর্কের জের ধরেই গড়ে তোলেন বদলি সিন্ডিকেট। নার্স বদলির এই সিন্ডিকেট সারা দেশে তাদের জাল বিস্তার করে রেখেছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, তার আটটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়টি অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি ৫২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৬ লাখ টাকা জমা করার নথি পাওয়া গেছে। সোনালী ব্যাংকের কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা কমপ্লেক্স শাখায় তার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৩০১৬৩০১০১৩০৮১। বিশেষ কোনো ব্যবসা না থাকলেও এই সঞ্চয়ী হিসাবটিতে সারা দেশ থেকেই টাকা জমা পড়ে। গত ২০২১ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসেই এই একটি হিসাবে ২১টি জেলার ৪৩টির বেশি শাখা থেকে ৬৩ বার টাকা জমা পড়েছে। ২০২১ সালের ২৬ জুলাই খোলা হলেও উল্লিখিত সময়ের মধ্যে অ্যাকাউন্টটিতে ১ কোটি ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ১১৮ টাকার বেশি লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে এবং এই সময়ের মধ্যে এই অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করা হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার ৩৫৪ টাকা। সঞ্চিত রয়েছে ২০ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬৪ টাকা।
জামাল উদ্দিনের যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া শাখার কৃষি ব্যাংকে রয়েছে পৃথক অ্যাকাউন্ট। যার সঞ্চয়ী হিসাব ৪১২৩০৩১০০৫০৯৭০। এতে ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৭ লাখ ৮৮ হাজার ২২২ টাকা জমা পড়েছে এবং উত্তোলন করা হয়েছে ৩৭ লাখ ৫৫ লাখ ৬৩৯ টাকা।
এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা কমপ্লেক্স শাখায় জামালের সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৩০১৬৩০১০১৩০৮১। সারা দেশ থেকে টাকা জমা পড়ে এই হিসাবটিতে। গত ২৭ জুলাই থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই হিসাবে ২১টি জেলার প্রায় ৪২টি শাখা থেকে ৬০ বার টাকা জমা হয়। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে- রাজবাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হবিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নীলফামারী, পাবনা, নরসিংদী, ঢাকা, জয়পুরহাট. বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার, সৈয়দপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রাঙ্গামাটি ও বগুড়া। চার মাসে এসব জেলা থেকে হিসাবটিতে ১ কোটি ৮০ হাজার ৫১৩ টাকার বেশি লেনদেন হয়। তথ্য অনুযায়ী, ওই হিসাবে ৩৮ লাখ ২১ হাজার ৪৪৬ টাকা জমা ছিল।
সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ-সিলেটে নার্স বদলির তদবিরে সিলেটের বিএনএ নেতা এবং এক নার্সিং কমর্কতার ভাই জড়িত ছিলেন। যিনি ওই এলাকার একটি পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবেও কর্মরত। আর বিএনএর ওই নেতা সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। এ ছাড়া সিন্ডিকেটে কুমিল্লায় একজন, খুলনায় একজন, রংপুর ও রাজশাহীতে দুজন, ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে দুজন এবং বরিশালে একজন ছিলেন। আর একজন গাড়িচালকের তত্ত্বাবধানে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাটে এই সিন্ডিকেট পরিচালিত হয়েছে।’
এদিকে, এ ঘটনায় একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করা হয়েছে। রিট আবেদনে অর্থের বিনিময়ে বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ এবং বদলি বাণিজ্যে লেনদেন হওয়া একশ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব, ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাওছার ও ব্যারিস্টার মোহাম্মদ মাজেদুল কাদের রোববার (২৪ এপ্রিল) এ রিট আবেদন দাখিল করেছেন।
বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ রিট আবেদনের ওপর শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব।
রিট আবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের অভিযুক্ত মো. জামাল উদ্দিনকে বিবাদী করা হয়েছে।
মন্তব্য