-->
শিরোনাম

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে ‘তিন ফর্মুলা’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের

কূটনৈতিক প্রতিবেদক
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে ‘তিন ফর্মুলা’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ‘তিনটি ফর্মুলা’ প্রস্তাব করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গতকাল রোববার (২৪ এপ্রিল) 'বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক: জোরদার সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব স্থাপন' শীর্ষক সেমিনারে ফর্মুলা তিনটি প্রস্তাব আকারে তুলে ধরেন তিনি।।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) আয়োজিত সেমিনারে পিটার হাস বলেন, 'আমি আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত তিনটি ক্ষেত্রে আলোকপাত করতে চাই: নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক।’

তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমরা আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে পারি। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমরা সহসাথী হিসেবে সম্পৃক্ত। আমরা বেশ কয়েকটি বার্ষিক অনুশীলন পরিচালনা করি। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দুদেশের নিজ নিজ বিশেষ অপারেশন বাহিনী বর্তমানে টাইগার শার্ক নামে একটি যৌথ মহড়া পরিচালনা করছে। আমরা অন্যান্য সমমনা পরস্পর-সহযোগী দেশগুলোর সমন্বয়ে এসব সম্পৃক্ততাকে আরো জোরদার করতে পারি।’

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা দুটি মৌলিক তথা ভিত্তিমূলক চুক্তিতেও যেতে পারি। জেনারেল সিকিউরিটি অফ মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (GSOMIA), যার আওতায় সামরিক ক্রয় সংক্রান্ত সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদানের মূলনীতি নির্ধারিত হবে। এই রূপরেখাটি বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর অভীষ্ট ২০৩০ অর্জনে অবদান রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির সহায়তায় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিং এগ্রিমেন্ট (ACSA)-এর আওতায় আমাদের সামরিক বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় একে অপরকে সহায়তা দিতে পারবে এবং বিমান, যানবাহন বা নৌযান কোনো সমস্যায় পড়লে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বা খুচরা যন্ত্রাংশ ধার দিতে পারবে, কিংবা শুধু জ্বালানি ও খাদ্য বিনিময়ে সক্ষম হবে।’

২০২০ সালে বিস্ফোরণের পর বৈরুত বন্দরে জাহাজ আটকেপড়া অথবা বঙ্গোপসাগরে যৌথ মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম চলাকালে নিরাপত্তা ও যৌথ কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টিতে এই ACSA-এর একটি প্রায়োগিক প্রভাব রয়েছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘GSOMIA ও ACSA সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। এগুলো কারিগরি চুক্তি। এগুলো ‘জোট’ বা ‘সামরিক চুক্তি’র পর্যায়ভুক্ত নয়। কিংবা এগুলো কোনো বিস্তৃত ও অস্পষ্ট প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিও নয়। যেমনটা ২০০২ সালে বাংলাদেশ করেছিল চীনের সঙ্গে।

‘এগুলো কেবল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির উপাদান হিসেবে এবং আপনাদের নিজ প্রতিরক্ষা অভীষ্টকে এগিয়ে নিতে আপনাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা করবে। তাছাড়া এগুলো প্রচলিত বিষয়। ৭০টিরও বেশি দেশ আমাদের সঙ্গে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।’

পিটার হাস বলেন, দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উৎসাহিতকরণ, যেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি।

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র নিখুঁত নয়। আমরা আমাদের নিজেদের গণতান্ত্রিক নবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এই যাত্রার মধ্যে রয়েছে পুলিশের জবাবদিহিতা বিষয়ে আমাদের নিজস্ব সমস্যা নিরসন এবং নির্বাচনের দিনে সমস্ত আমেরিকান যেন ভোট দিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। সেইসঙ্গে আমরা সারা বিশ্বের দেশগুলোকেও তাদের গণতন্ত্রকে জোরদার করতে একই ধরনের অঙ্গীকার গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাবে মর্মে বিবৃতি দেওয়ায় আমি সন্তোষ প্রকাশ করছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার রোধে এ আইন সংস্কারে আইনমন্ত্রীর সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতিকেও আমি স্বাগত জানাই।

‘আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু নির্বাচনের দিন ভোটদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কার্যত, ইতোমধ্যেই নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আবশ্যক হলো নাগরিকদের মতামত প্রকাশ, সাংবাদিকদের ভীতিহীন অনুসন্ধান এবং সুশীল সমাজের ব্যাপক পরিসরে জনমত গঠনের সুযোগ নিশ্চিত করা।’

তিনি বলেন, ‘আমি সুস্পষ্ট করতে চাই যে, আসন্ন নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ বেছে নেবে না। আমরা শুধু এমন একটি প্রক্রিয়ার প্রত্যাশা করি, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, কে দেশ চালাবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘তৃতীয়ত, আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত। আগামী মাসে আমি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির উদ্বোধনী সফরকে স্বাগত জানাব।

‘আমি এই গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ কমার্স থেকে সর্বপ্রথম পূর্ণকালীন অ্যাটাশেকে স্বাগত জানানোর ঘোষণা দিতে পেরে গর্বিত বোধ করছি। আমাদের দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধিতে আমরা যে গুরুত্ব দিয়েছি তার অন্যতম প্রমাণ এই পদক্ষেপ।’

মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বড় অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে সমান তালে প্রতিযোগিতা করবে মন্তব্য করে পিটার হাস বলেন, ‘মেধাস্বত্ব অধিকার, সরবরাহ ব্যবস্থার সক্ষমতা, মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার সুযোগ এবং স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসা পরিবেশের মতো বিষয়গুলো আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ যেভাবে ইন্টারনেট কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে সেটা বিদেশি বিনিয়োগ ও বিভিন্ন কোম্পানির বাংলাদেশে ব্যবসা করার আগ্রহকেও প্রভাবিত করবে। এছাড়া আরো অনেক সুযোগ আছে, যার সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারি।

‘উদাহরণস্বরূপ, নতুন প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বা ডিএফসি)-এর দক্ষিণ এশিয়াব্যাপী দূষণমুক্ত জ্বালানি, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও ব্যাঙ্কিংসহ বিভিন্ন খাতে ৪ বিলিয়ন ডলারের সক্রিয় অর্থায়ন রয়েছে। স্বচ্ছ ব্যবসায়িক পরিবেশ উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ বা আইএলওর পথনকশায় নির্ধারিত সময়সীমা পূরণের মতো কঠিন কাজ আমরা করতে পারি না। এসব পদক্ষেপ নির্ভর করছে বাংলাদেশের ওপর। তবে আমরা এই প্রক্রিয়া অনুসরণে সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমাদের দুটি দেশ গত ৫০ বছরে একসঙ্গে একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে। আমাদের দুদেশের মানুষে মানুষে বন্ধন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী।’

তিনি জানান, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করেন এবং তারা বিদেশি শিক্ষার্থী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ১৪তম এবং তাদের সংখ্যা দ্রুততম হারে বাড়ছে।

পিটার হাস বলেন, ‘প্রাণচঞ্চল বহুদেশীয় জনগোষ্ঠী ও শক্তিশালী ব্যবসায়িক সংযোগ আমাদেরকে নিবিড়ভাবে পরস্পর যুক্ত রাখে।

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের অংশীদারিত্ব জোরদার করতে এবং আমাদের সম্পর্কের বিশাল সম্ভাবনা বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা নিতে প্রস্তুত। আমরা বাংলাদেশের গতির সঙ্গে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।’

মন্তব্য

Beta version