নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুতদার এবং অসাধু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্যে সরকারের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে এলেও সেই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। দফায় দফায় জরিমানা করা হলেও যেই-সেই অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছেন ব্যবসায়ীরা।
এরই ধারাবাহিকতায় পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হয়ে গেছে। দাম বাড়ার গুজবে সাধারণ ব্যবসায়ীরা পণ্যটির মজুত করেছে বলে জানা গেছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে ভোক্তা অধিদপ্তর।পূর্ব জুরাইনের গৃহবধূ উলফাতুন্নেসা বুধবার বিকেলে বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে যেয়ে পাননি। তিনি জানান, দোকানে ৫ লিটার, দুই লিটার বা এক লিটারের বোতল নেই। রূপনগর আবাসিক এলাকার ১৮ নম্বর সড়কের মাহিউজ্জামান শাওনেরও একই অভিযোগ। তিনি এলাকার অনেকগুলো দোকেন ঘুরেও এক লিটার সয়াবিন তেল পাননি। নিরুপায় হয়ে দুই লিটারের সরিষার তেল কিনেছেন।
একই অবস্থা মিরপুর সেনপাড়া পর্বতার জাফর আহমেদের। তিনি বলেন, এক দোকানে যেয়ে তেল পাইনি। আরেক দোকানি আমার পরিচিত। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, তেল লাগলে নিয়ে যান। দুই লিটারের বোতল। কিন্তু বৃহষ্পতিবার থেকে পাবেন না।
বাজারে তেলের সংকটের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা একপক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলমান সংকট খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা সৃষ্টি করেছেন। পাম তেলের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া সম্প্রতি রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর দেশের বাজারে আবারো অস্থির হয়ে উঠে ভোজ্যতেলের বাজার। এই সুযোগ নিচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ফলে ঈদকে সামনে রেখে রাতারাতি হাওয়া করে দিয়েছে বোতলজাত সয়াবিন তেল।
জানা গেছে, গত দুই মাস থেকে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি, উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে কিছুদিন ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকলেও মাঝে মধ্যেই মাথাচড়া দিয়ে উঠে তেলের বাজার।
নতুন করে ঈদকেন্দ্রিক আবারো ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার খোলা সয়াবিন তেলের দাম বোতলজাত সয়াবিনের থেকে বেশি হওয়ায় অনেকে বোতলের মুখ খুলে তা খোলা তেল হিসেবে বিক্রি করছেন।
ঢাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আপাতত তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে মিল মালিক বা সরবরাহকারীরা জানিয়েছেন, সরকার ঠিক করা দামেই তারা পাইকার ও ডিলারদের তেল দিচ্ছেন। দাম বাড়ার বা সংকট তৈরি হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
এ দিকে সরকার নির্ধারিত দাম বোতলজাত প্রতি লিটার ১৬০ টাকা, ৫ লিটার ৭৬০ টাকা এবং খোলা সয়াবিনের লিটার ১৩৬ এবং পাম তেলের লিটার ১৩০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও এই দামে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বা পাম তেল ১৮০ বা তারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে বোতল সয়াবিন তেল দাম ১৬৮ বা ১৭০ টাকা হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদ ঘনিয়ে আসায় মুদির দোকানে ক্রেতারা বোতল জাত সয়াবিন তেল চাইলেও পাচ্ছে না।
জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারি শেষের দিকে ভোজ্যতেলের দাম ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর ১০ বা ১২ দিন পর ব্যবসায়ীরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধকে সামনে এন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে বলে আবার দাম বাড়ানোর জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। সেই সময় সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছিল রোজার আগে তেলের আর দাম বাড়বে না। সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও বাজারে শুরু হয় ভোজ্যতেলের হাহাকার। খোলা তেলের লিটার ২০০ টাকা উঠে যায়, এতে দোকানিরা বোতল সয়াবিন মুখ খুলে বিক্রি শুরু করেন।
ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে এফবিসিসিআই ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আমদানিকারক, সরবরাহকারি, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসেন। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করে। আর ভোক্তা অধিদপ্তর পর্যায়ক্রমে পাইকারি ও সরবরাহ পর্যায়ে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
তবে ওই সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট থেকে ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ এবং ভোক্তা পর্যায়ের ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে। ফলে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্ধারিত দাম থেকে বোতল সয়াবিনের দাম লিটারে ৮ টাকা কমে ১৬০ টাকা এবং পাঁচ লিটার ৭৯৫ টাকার পরিবর্তে ৭৬০ টাকা ঠিক করা হয়। খোলা তেল ১৩০ বা ১৩৬ টাকা ঠিক করা হয়।
এর পর মার্চের শেষের দিকে বা রমজান মাস উপলক্ষে বাজারে আবার ভোজ্যতেলের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ বুঝতে (রোজার শুরুতে) এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোক্তা অধিদপ্তরে বৈঠকে আমদানিকারকরা বলেছিলেন, আগামী কয়েক মাসের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে ভোজ্যতেলের কোনো ঘাটতি হবে না। তবে বাড়তি ডলারে তেল কিনতে হচ্ছে বলে তারা সেই সময়ে দাবি করেন।
চলমান পরিস্থিতির বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র এজিএম তাসলিম শাহরিয়ার ভোরের আকাশকে বলেন, ‘মিল গেট এলাকায় কোনো সমস্যা নেই। সরবরাহ ব্যবস্থা সাভাবিক রয়েছে। পাইকারি বাজারে কি হচ্ছে তা’ এখন আমার জানা নেই। সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা মেনেই আমরা কার্যক্রম চালাচ্ছি।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার থেকে মৌলবিবাজার এলাকায় খোলা সয়াবিন বা পাম তেলের ব্যবসা বন্ধ রয়েছে। বাজার অস্থিরতার সঙ্গে তাদের কোনো হাত নেই। খুচরা ব্যবসায়ীরা এটি করলে করতে পারে। ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় দাম কি হয়েছে, কত হয়েছে তা’ বলতে পারছি না।’
তবে ঈদের পরে সব পক্ষের সঙ্গে বসে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘কমিশন মূলত পাইকারি বা উৎপাদক পর্যায়ের বাজার নিয়ে কাজ করে থাকে। খুচরা বাজার নিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর কাজ করছে। ভোজ্যতেলের বাজার দর বিষয়ে আমাদের নিকট কেউ অভিযোগ করেনি। তবে কমিশনের আইনের ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আমরা একটি মাঠ জরিপ করেছি, এর ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি কাজ চলছে। ঈদের পরে প্রতিবেদন প্রকাশ ও এর ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয় হবে।’
আর ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ভোরের আকশকে বলেন, মিল মালিকদের কাছ থেকে প্রতিদিনের সরবরাহ হিসাব পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সেখান থেকে ভোজ্যতেলের কোনো সমস্যা পরিলক্ষিত হয়নি। মাঠ পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেছে, খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে গুজব ছড়িয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করছেন। অনেকে তেল মজুত করেছেন। এতে ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযান দিয়েছে। অনেকে অন্য মালের মধ্যে বোতল সয়াবিন তেল লুকিয়ে রাখেছে, বা দোকান থেকে সরিয়ে রাখছেন। আমরা অনুরোধ করেছি, এ কাজটি যাতে না করেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভোক্তাদের হয়রানি না করেন। ব্যবসায়ীদের এ ধরনের কার্যক্রম প্রমাণিত হলে সরকারের যে নির্দেশনা রয়েছে, তার ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য