কয়েক লাখ বা কয়েক কোটি টাকা নয়। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমিতির ১৭৬ কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। এই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে একই প্রতিষ্ঠানের গুটিকয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গে জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তার নামও জড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ উদ্ধারে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি সংস্থাটি। শুধুই চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমাবদ্ধ টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া। অভিযোগ রয়েছে, লাগামহীন এই অনিয়ম ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করছেন জড়িতরা। টাকার হিসাব চাইতে গিয়ে উল্টো সমিতির কেউ কেউ হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
#চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ টাকা উদ্ধারের প্রক্রিয়া
# লাগামহীন এই অনিয়ম ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করছেন জড়িতরা
জানা যায়, ওয়াসার পানির বিল আদায়ে নিয়োগকৃত ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে এই সমিতি। নিয়মানুসারে, ওয়াসার বিল উত্তোলনের বিনিময়ে শতকরা ১০ টাকা হারে কমিশন পেয়ে থাকে এই সমিতি। এই টাকা থেকে নিয়মিত লভ্যাংশ পাবার কথা সদস্যদের। কিন্তু প্রতি বছর শত কোটি টাকা আয় করলেও নিয়মানুসারে সমিতির সদস্যরা কোনো লভ্যাংশ পাচ্ছেন না। এমনকি শতকরা ১০ টাকা হারে পাওয়া কমিশনের বিপুল পরিমাণ টাকার হদিসও মিলছে না এখন। অডিটেও মিলছে না হিসাব। এই টাকা উদ্ধারে চিঠি চালাচালি হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
অভিযোগ উঠেছে, নতুন কমিটির কাছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বুঝিয়ে দিতে সময়ক্ষেপণ করছে ব্যাংক ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। বিশাল অংকের টাকা তসরুপ ঠেকাতে উদ্যোগ নেওয়ার বদলে দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করার অভিযোগ রয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, মূলত পানির বিল আদায়ের পরিমাণ বাড়াতেই ঠিকাদার নিয়োগ করেছিল ওয়াসা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পানি ও স্যুয়ারেজ বিল বাবদ ১৩০৬ কোটি টাকা আদায় হয়। সেই হিসেবে ঢাকা ওয়াসা থেকে ওই বছরে সমবায় সমিতি কমিশন পায় ১৩০ কোটি টাকা। প্রতি বছর গড়ে ১০০ কোটি টাকার কমিশন পেয়ে থাকে সমিতি। এই আয় থেকে সদস্যদের মধ্যে লভ্যাংশ হিসাবে বিতরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে আট শতাংশ। এছাড়া সমিতির নিজস্ব জনবলসহ বিভিন্ন খাতে খরচ হয় দুই শতাংশ টাকা। যা মাত্র দুই কোটি টাকা। সমিতির ফান্ডে শত শত কোটি টাকা থাকলেও পাঁচ বছর ধরে লভ্যাংশ পাচ্ছেন না সদস্যরা। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে সদস্যদের মধ্যে।
সমিতির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে গত ৬ এপ্রিল ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি লিখেছেন সমিতির সম্পাদক মো. শাহাব উদ্দিন সরকার। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত দুই বছরের অডিট রিপোর্ট অনুসারে ১৩২ কোটি টাকার হিসাব নেই। তহবিল তসরুপ ছাড়াও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে সমিতির গাড়ি। এসব বিষয়ে তদন্তের উদ্দেশে সমিতির পক্ষ থেকে তথ্য চাওয়া হলেও ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়নি। উল্টো সমিতির ৯ জনকে বিভাগীয় মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
ওই ১৩২ কোটি টাকা ছাড়াও সমিতির জনতা ব্যাংকের হিসাব থেকে উধাও হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। কে বা কারা এই টাকা তুলে নিয়েছে তারও হদিস মিলছে না। অডিট কমিটির চাহিদার প্রেক্ষিতে ঢাকা ওয়াসার প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা লিখিতভাবে জানান, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত পিপিআই প্রকল্পের ঠিকাদারি বিল বাবদ ঢাকা ওয়াসা কর্তৃক সমিতিকে দেওয়া হয় ১৩৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭৬ হাজার ৯৬৩ টাকা। কিন্তু ওই সময়ে সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৯২ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার ২১৩ টাকা। বাকি ৪১ কোটি ৭০ লাখ ৮০ হাজার ৭৫০ টাকা ব্যাংকে জমা হয়নি।
এ বিষয়ে মো. শাহাব উদ্দিন সরকার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, এই বিপুল অর্থ অন্য কোনো ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে নাকি ঢাকা ওয়াসা থেকে ক্যাশ পে চেক দেওয়া হয়েছে কিংবা ঢাকা ওয়াসা থেকে বিল দেওয়া হয়নি তার কোনো তথ্যই মিলছে না। অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি।
এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের জন্য জনতা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা এবং ব্যাংক লেনদেনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়াসার কর্মচারী সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান ও মিজানুর রহমানসহ তখনকার কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমিতির কমিটি নিয়েও রয়েছে আইনি জটিলতা।
২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের এক দিন আগে ঢাকা ওয়াসা সচিব স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে ‘সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের সভা, সমাবেশ, নির্বাচনী প্রচারণা, ভোটদান করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ প্রদান করা হয়। অন্যথায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।’
করোনার বিস্তারের কারণেই এমন ঘোষণা দেওয়া হয় বলে জানানো হয়। কিন্তু নির্বাচনী অংশগ্রহণকারীরা জানান, ওই সময়ে সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনায় সংক্রমণের হার নিম্নমুখী ছিল। ওই নিষেধাজ্ঞার পরও ওয়াসা ও সমবায় অধিদপ্তর যৌথভাবে নির্বাচনের আয়োজন করে। পরবর্তীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ১০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এর পেছনে সমিতির অর্থ আত্মসাতের জন্য দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা ও সমিতির সাবেক কয়েক নেতাকে দায়ী করছেন সদস্যরা।
ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমিতির সভাপতি মুহাম্মদ আতাউল করিম ভোরের আকাশকে বলেন, ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অনিয়ম হয়েছে। ওই সময়ে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারাই এজন্য দায়ী। ওই সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উধাও হয়েছে। এই অর্থের কোনো হদিস নেই। এসব অনিয়ম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর নির্বাচনের আয়োজন করে। যে নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা বিজয়ী হয়েছি। এখন অর্থ উদ্ধারের জন্য সমবায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরের চিঠি দিয়েছি। সবার সহযোগিতা চাচ্ছি।’
মন্তব্য