-->
শিরোনাম

তেল নিয়ে বাজার গরম, ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ

বছরে লিটারে বেড়েছে ৮০ টাকা

রুদ্র মিজান
তেল নিয়ে বাজার গরম, ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ
ছবি: সংগৃহীত

বাজারে অস্বস্তি, ক্রেতারা বিক্ষুব্ধ। তেল নিয়ে হচ্ছে তেলেসমাতি। একলাফে, এক মাসের মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৩৮ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে লিটারে বেড়েছে ৮০ টাকা। তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে রেস্টুরেন্টের খাবারের মূল্য। বাড়বে তেল সংশ্লিষ্ট সব খাবারের দাম। এর মধ্যে তেল উধাও হয়েছে বিভিন্ন দোকান থেকে।

শনিবার (৭ মে) থেকে নতুন মূল্য কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও গত বৃহস্পতিবার থেকেই এই দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন। কেউ কেউ নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

‘হাফ আর এক লিটার দূরে থাক। সয়াবিনইতো নেই।’-দোকানের মালিকের কথা শুনে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ইরফান শেখ। কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন, ‘যেভাবে দাম বাড়ছে তেল কিনন লাগব না। তেল ছাড়াই রানতে অইবো। এক টাকা, দুই টাকা না, এক্কেবারে ৩৮ টাকা বাড়ছে। এইটা কোনো কথা। দেশে কথা কওনের মানুষ নেই।’-বলেই ক্ষুব্ধ এই ক্রেতা ফিরে যান।

ঘটনাটি ঘটে শুক্রবার (৬ মে) দুপুরে রাজধানীর রামপুরার মহানগর প্রজেক্টের পাঁচ নম্বর সড়কের একটি দোকানে। দিনভর এভাবেই বিভিন্ন মুদি দোকানে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে ক্রেতাদের। জুমার নামাজের শেষে চার জনের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা হচ্ছিল। স্থান খিলগাঁও তিলপাপাড়ার ছয় নম্বর সড়কের একটি দোকান। বিষয় সয়াবিন তেল।

চার জনের বয়স ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে জামিল আহমেদ নামে এক ব্যক্তি বললেন, ‘পৃথিবীর কোন দেশে এরকম হয়? এক মাসে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে দিছে। রাতারাতি কিছু ব্যবসায়ী হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন। গত বছরে এই তেলের দাম ছিল ১১৮ টাকা লিটার। এখন ১৯৮ টাকা। দেশটা মগের মুল্লুক হয়ে গেছে।’

পাশে দাঁড়ানো আসিফুর বলছিলেন, ‘দেশতো উন্নত হইছে। কিছু মানুষতো আঙুল ফুলে কলাগাছ হইছে। তাদের জন্য ১ হাজার টাকা লিটার হইলেও সমস্যা নাই। তারা এমনিতেই দামি তেল খায়। সমস্যাতো সব আমাদের মতো গরিবের।’

এবার দোকানের মালিক নিজেই অংশ নেন। তিনি বলেন, ‘ভাই আমাদের দেশপ্রেম নেই। ইন্ডিয়াতে পঞ্চাশ পয়সা দাম বাড়লে আন্দোলন করে। আমরাতো ঘুমায়ে থাকি। তাই যার যা খুশি করতেছে। আমাদের মতো ছোট দোকানদারদের কিচ্ছু করার নেই। যারা বড় ব্যবসা করেন তারাই দেশ চালান।’

এবার দূর থেকেই জোরে আওয়াজ করেন শরীফ উদ্দিন। ‘শুধু খারাপটাই দেখবা। ভালো কিছু চোখে পড়বে না। সরকার যে সারা দেশের মানুষকে করোনার টিকা দিল, এটা অনেক বড় সফলতা। সেটাতো বুঝেও বুঝবা না। দাম বাড়ছে, নিয়ন্ত্রণেও আসবে।’

এবার জামিল আহমেদ ক্ষেপে যান। বলেন, ‘আপনিতো বলবেনই। আপনারতো ঠিকাদারি আছে। গরিব মানুষের কথা ভাবনার সময় নেই আপনাদের। বিদেশ থেকে ঋণ করে করে প্রকল্প নিয়ে লুটপাট হয়। আবার ক’দিন পরপর তেলের দাম বাড়ায়। দাম যেটা বাড়ে সেটা বাড়তেই থাকে। কমেছে কোনো দিন? আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার আগেই আমাদের দেশে বাড়ে। বাড়েতো বাড়ে কয়েক গুণ বেশি। সব দেশে দাম কমে, কিন্তু আমাদের কমে না।’ এভাবেই চলছিল সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলা আলাপচারিতা।

মালিবাগ এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক রশিদের সঙ্গে। বাড়ি রংপুরে। বউ, বাচ্চা নিয়ে থাকেন মধুবাগে। প্রতি মাসে রিকশা চালিয়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। সেখান থেকে ঘরভাড়া ছয় হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে খাবার, পোশাক ও চিকিৎসায় ব্যয় করতে গিয়ে হিমশিম খান তিনি। মাঝে-মধ্যে গ্রামে মাকে টাকা পাঠানোর ইচ্ছা থাকলেও তা অনেক সময় হয়ে উঠে না। তেলের দাম বাড়ার খবর পেয়েছেন বৃহস্পতিবার রাতেই।

ক্ষুব্ধ এই রিকশাচালক বলেন, ‘টাকাওয়ালারা দামি দামি গাড়ি দৌড়ায় রিকশায় উঠে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা। ভাড়া কম। বকশিশও তেমন নেই। তেল দিয়ে আর রান্না করা যাবে না। শুধু কি তেল! সবকিছুর দাম বেশি। আমাদের বাঁচার সুযোগ কমে যাচ্ছে।’

মগবাজারের এশটি রেস্টুরেন্টের মালিক আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। তেলের দাম বাড়লে খাবারের দাম বাড়াতে হবে। রেস্টুরেন্টে খেতে এসে তখন বিল নিয়ে অনেকে ঝামেলা করবে। কিন্তু আমাদের কী করার আছে। রান্না করতে গেলে তেল তো লাগবেই।’

ইরাজ চাকরি করেন বেসরকারি একটি কোম্পানিতে। ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ‘বছরের পর বছর যায় বেতন বাড়ে না। ঈদে বোনাস দিতে চায় না। আন্দোলন করে নিতে হয়। মাস শেষে দোকানে বাকি থাকে হাজার হাজার টাকা। সেখানে তেলের দাম বাড়ছে। তাও একলাফে ৩৮ টাকা। এই দেশে আমরা মনে হয় বাঁচতে পারব না।’

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি বেড়েছে ৮০ টাকা। ২০২১ সালের ৫ মে বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১১৮ টাকা। গত চার বছরে যেসব ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে তার মধ্যে অন্যতম সয়াবিন ও পামওয়েল। সর্বশেষ গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন তেলের দাম বাড়িয়েছে। তখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ করেছিল। এবার নতুন করে দাম নির্ধারণের ফলে এখন থেকে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হবে ১৯৮ টাকায়। ২০১৯ সালে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১০৪ টাকা। ২০২০ সালে সেটি বেড়ে হয় ১১৩ টাকা। ২০২১ সালে ১৩০ টাকা। ২০২২-এর শুরুতে এসে হয় ১৬৮ টাকা।

মন্তব্য

Beta version