মেহেদি হাসান (২১) বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ঈদের দিন থেকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। সন্তানের এমন অবস্থার মধ্যে পরিবারের আর ঈদ উদযাপন হয়নি। সন্তান আগের মতো সুস্থ হবে কি না এমন দুশ্চিন্তা কাটছে না।
নানা আশঙ্কার মধ্যে মা আর মামা ঢাকা মেডিকেলের ১০২ নং ওয়ার্ডে ১৪ নং বেডের পাশে বসে রাত-দিন পার করছেন। মেহেদি হাসানের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি এলাকায়। অনভিজ্ঞ চালক হওয়াতে এবং দ্রুতগতির মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সিএনজির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুর্ঘটনাটি ঘটে। এই দুর্ঘটনায় মেহেদির একটি পা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায় এবং আঘাত লেগে পেটের ভেতর নাড়ি-ভুঁড়ি ফেটে যায়!
কীভাবে অ্যাক্সিডেন্ট হলো এবং সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কেমন এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভোরের আকাশের সঙ্গে কথা হয় মেহেদির মেজো মামা মো. বাশারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার ভাগিনার নিজস্ব মোটরসাইকেল ছিল না। সে বন্ধুর গাড়ি চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তার বেশ কিছু বন্ধুর নিজস্ব মোটরসাইকেল আছে। মেহেদিও হোন্ডা কিনে দিতে বাসায় অনেক আবদার করেছিল। একমাত্র সন্তান হওয়াতে এবং তার বাবা বিদেশ থাকায় মা ভয়ে বিপজ্জনক এই যানটি কিনে দিতে রাজি হননি।
তবে বন্ধুদের থেকে হোন্ডা নিয়ে মাঝেমধ্যেই ঘুরতে বের হতো সে। ঈদের দিন এক বন্ধুর থেকে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে যাবার সময় গতি থাকায় নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সিএনজির সঙ্গে লাগিয়ে দেয়। পরে তাকে কুমিল্লার গৌরিপুর হাসপাতালে নিলে সেখানের ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়। ডাক্তার বলছে, পায়ের হাড় গুঁড়ো হয়ে গেছে এবং পেটের নাড়ি ফেটে গেছে। সে স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারবে কি না এ নিয়ে ডাক্তার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ’
ঈদের ছুটিতে এমনই আরেক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ৩৫ বছরের শেখ রুহুল ইসলাম। ঈদের পরের দিন তিনি বরগুনার পাথরঘাটা থানার হাইওয়েতে মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন। ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কায় দুর্ঘটনার শিকার হন। তার জখম ছিলো গুরুতর। তিনি মাথায় এবং চোখে আঘাত পান।
পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত তাকে আনা হয় রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। তবে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সংকট থাকায় ১০৩ নং ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। অর্থের অভাবে রুহুলকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছে না পরিবার।
পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রুহুল পেশায় একজন সবজি বিক্রেতা। তার ছোট ছোট দুটি মেয়ে এবং একটি ছেলেসন্তান রয়েছে।
রুহুলের অবস্থা নিয়ে কথা হয় তার বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে বাঁচবে কি না জানি না। রুহুলের কিছু হলে এই বয়সে আমি নাতিদের নিয়ে কই যাব। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আমার মানিক যেন আমার কাছে ফিরে আসে। এ রকম দুর্ঘটনা যেন আর কারো না হয়। সবাই যেন সাবধানে গাড়ি চালায়।’
গতকাল সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের ভিড় দেখা গেছে ওয়ার্ডগুলোতে। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আহতদের মধ্যে বেশির ভাগই তিন চাকা যেমন-অটোরিকশা, করিমন-নছিমন, ভ্যান এবং দুই চাকার যান যেমন-মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। চার চাকার পিকআপ দুর্ঘটনায়ও আহত হয়েছেন কেউ কেউ। আহতদের অনেকে ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, ঈদের ছুটির ১০ দিনে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে তিনটি ওয়ার্ডে ৯৪ জনের মতো সড়ক দুর্ঘটনা রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৫ জন মারা গেছেন। আর প্রায় বিশ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আশঙ্কাজনক একজন রোগীর পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। যিনি ১০২ নং ওয়ার্ডে ঈদের দিন থেকে ভর্তি আছেন। এবার আহতদের ৬০ শতাংশই তিন ও দুই চাকার ছোট পরিবহণে দুর্ঘটনার শিকার বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে একটা জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এ ক্ষেত্রে অনেক ধরনের ব্যবস্থাপনা এবং সুপারিশ আছে। মূলত রোড়, ড্রাইভার, যানবাহন এবং আবহাওয়া এই চার ধরনের বিষয়ের কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভারের পর্যাপ্ত পরিমাণ দক্ষতা থাকে না।
তিনি বলেন, চালক গাড়ি চালানোর জন্য মেডিকেলি ফিট কি না অর্থাৎ তার দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা আছে কি না এগুলো কিন্তু তেমন ভালোভাবে দেখা হয় না আমাদের দেশে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আমাদের রোড কন্ডিশন ভালো না থাকায় এবং বেশি স্পিডে চালানোর ফলে দুর্ঘটনা হয়। সব মিলিয়ে এটা হচ্ছে এক ধরনের সচেতনতার বিষয়।
ঈদ যাত্রায় দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এই পরিচালক বলেন, ‘বড় কোনো ধরনের যানবাহনের ভিড় হবে এমন কোনো উৎসব যেমন- ঈদ বা অন্য কোনো ধর্মীয় উৎসবে চালকদের যদি মিডিয়ার মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে সচেতন করা যায় তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
তিনি বলেন, যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা এটা একটা জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা, তাই ছোট বেলা থেকেই যদি এ ব্যাপারে সচেতন করা হয় অর্থাৎ এ বিষয় যদি শিক্ষা কারিকুলামে যুক্ত থাকে তাহলে ভবিষ্যতে মানুষ অনেকে সচেতন হবে। তবে যদি দুর্ঘটনা হয়েই যায় তাহলে প্রথম এক ঘণ্টার ভেতরে যদি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যায় তাহলে রোগীর জীবন বাঁচানো বা অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রক্ষা করা সম্ভব। যত দ্রুত সম্ভব দুর্ঘটনার রোগীকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন ঢামেক হাসপাতালের এই পরিচালক।
মন্তব্য